শিশুকাল থেকেই আমাকে শ্রম দিতে হতো। তবে সেটা সম্প্রতিকালের শিশুশ্রম পড়বে কিনা তা ভাববার বিষয়। সেই শ্রম মজুরির বিনিময়ে না, পরিবারের কল্যাণে সেটা প্রয়োজন হত। শিশু বয়সে এর কোনোটাই আমার কাছে আকর্ষণীয় ছিল না।
আমাদের দো-হালের পরিবার, এছাড়া দুধের গরু ছিল। গরু বাধার জন্য পাটের দড়ির প্রয়োজন হতো। তখনকার দিনে নাইলনের দড়ি দিয়ে গরু বাধা হতো না। বাজারে মোটা নাইলনের দড়ি পাওয়া যেতো না। নাইলনের সুতো পাওয়া যেতো তার দামও বেশি ছিলো। মাছ ধরার জন্য নাইলনের সুতা ব্যবহৃত হতো। পাটের দড়ি এক বছরের বেশি টেকসই হতো না। বর্ষায় পচনে দুর্বল হয়ে যেত। তাই প্রতিবছরই দড়ি পাকাতে হতো। এছাড়া মলনের দাওন, ঘরের চালের খুঁটি কানার জন্য দড়ির দরকার হত। দড়ি পাকানোর জন্য আব্বাকে সাহায্য করতে হতো। জন (কামলা) নিয়ে দড়ি পাকানোর মতো কাজ আর্থিক বিবেচনায় সঠিক ছিল না। তাই দড়ি পাকানোর জন্য শৈশব থেকেই আব্বাকে সাহায্য করতে হতো, যা আমার জন্য বিরক্তিকর ও কষ্টকর ছিল। আমাকে দড়ির একপ্রান্ত ধরে রাখতে হত, অপরপ্রান্ত থেকে আব্বা দড়িতে পাক দিতেন। বেশি পাক হয়ে গেলে আমার ধরে রাখার শক্তির বাইরে চলে যেতো। তাই হাত থেকে দড়ি ছুটে যেত। এজন্য আমাকে মার খেতে হতো। পাড়ার কারও আসার অপেক্ষায় থাকতাম, যেন সে দায়িত্বটা নেয়। কোন কোন সময় তাই হতো।
লেখাপড়ার করার জন্য কখনো (ল্যাম্প) ল্ম্প, হারিকেন ব্যবহৃত হতো। প্রতিদিন হারিকেনের চিমনির কালি পরিষ্কার করতে হতো। এটি আরেকটি বিরক্তিকর কাজ। এখনকার মত শেষ সময়ে চিমনির প্রান্ত মসৃণ ছিল না। কালি মুছার সময় কখনো কখনো হাত ছিলে যেত।
বীজ বোনার জন্য জমি প্রস্তুত, ফসল বোনা, ধান রোয়া, আগাছা পরিষ্কার, ফসল তোলা, ফসল মাড়াই ইত্যাদি কাদের জন্য জনের (কামলা) দরকার হত। আমাদের প্রায় ৬০ বিঘা জমি ছিল। সেজন্য অনেক জন (কামনা) নিতে হতো। সাধারণত তাদেরকে দু’বেলা খাবার দেয়া হতো। বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে আমাকে মাঠে জোনের খাবার নিতে হতো। জন সংখ্যা কম হলে খাবার হিসেবে পান্তা ভাত ও খেজুরের গুড়, পান্তাভাত মিষ্টি কুমড়া দেয়া হতো। সংখ্যা বেশি হলে নারকেল ও আতপ চালের ক্ষীর এবং ঝোলাগুড় দেওয়া হত। একসাথে ২০-২৫ জন নেয়া হতো। সকালে উঠে মা ক্ষীর রান্না করতেন। সবসময়ই ক্ষীর গরম থাকতো। সৌভাগ্যজনকভাবে তখনকার দিনে বেতের ধামায় ক্ষীর নেয়া হতো। বেত তাপের কুপরিবাহী তাই বেশি গরম হতো না। আমাকে ধামা মাথায় করে এই ক্ষীর ক্ষেতে নিতে হতো। মায়ের ধারণা ছিল গরম ক্ষীর নিলে ব্রেন নষ্ট হবে। তাই আব্বার এই সিদ্ধান্তের জন্য কান্নাকাটি করতেন। তবুও তার ওপরে কথা বলতেন না। আমার মত ছোট শিশুর জন্য এটি নেয়া খুবই কষ্টকর হত। তারপরও নিতে হতো। কখনো কখনো ২/৩ টি জন নেয়া হতো। সেক্ষেত্রে খাবার হিসেবে পান্তাভাত দেয়া হতো। এলুমিনিয়ামের গামলায় পান্তাভাত নেয়া হতো। গামছা দিয়ে গামলা বেঁধে হাতে ধরে মাঠে ভাত নেয়া হতো। কিম্বা মাথায় করে নেয়া হতো। প্রায় সময় পান্তাভাতের পানি গড়িয়ে গায়ে পড়তো।
ঘান ভাঙ্গানো আর একটা কুড়ে কাজ। সারাদিন বসে থাকতে হতো। কোন কোন সময়ে ঘানের উপরে বসে ঘুরতে হত। একাধারে পাঁচ কেজি সরিষা ভাঙালে আড়াই কেজি তেল হত। কোন কোন সময় আধামন একবারে ভাঙ্গিয়ে নেয়া হতো। এতে অনেক সময় লাগত। অনেকদিন মাথায় করে আনার সময় তেলের কাড়ে কাত হয়ে তেল পড়ে যেত। এ নিয়ে একটা গ্রামের প্রবাদ আছে “তেলের লাভ খইলে যাওয়া”। অর্থাৎ তেল ভাঙিয়ে আনার সময় কাড়ে কাত হয়ে তেল খইলে শুষে নেওয়া।
তখনকার দিনে লম্বা আউশ ধান হত। আউশ ধানের বড় বড় আঁটি বাঁধা হত। উঠানে একটা বাঁশের খুঁটি পোতা হত যাকে মেই খুটি বলে। আউশ ধানের আঁটি গুলো খুলে মেই খুঁটির চারপাশে গোল করে ছড়িয়ে দেওয়া হত। দাওন নামের একটা দড়ি দিয়ে তৈরি বস্তুর সাথে ৫/৬ টা গরু গেতে দেওয়া হতো। এর এক প্রান্ত মেই খুটির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। এরপর গরুকে তাড়া দিলে মেই খুটির চারপাশ দিয়ে ঘুরত। এদের পায়ের চাপে শীষ থেকে ধান আলগা হয়ে যেত। পল থেকে ধানগুলো ঝেড়ে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হতো।
মলন মলা একটি বিরক্তিকর কাজ ছিল। গরুর পিছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরতে হত। কষ্টকর, বিরক্তিকর এবং মাথা ঘোরাতো। ভাদ্র মাসে হঠাৎ করে বর্ষা হতো। তখনকার দিনে প্লাস্টিক বা পলিথিন পাওয়া যেত না। বর্ষা আসলে দ্রুত মলন তুলে ফেলতে হত। মলন মলার সময় গরুর ন্যদের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হতো। ন্যাদ শুরু করার সাথে সাথে পল ধরা হত যেন নিচে পড়ে গরুর পায়ের আঘাতে ছড়িয়ে না পড়ে
একটা কথা আমার জীবনে দাগ কেটে আছে। একদিন জনের খাবার নিয়ে এক কিলোমিটার দূরের ক্ষেত ঠাকুর বাড়ি যাচ্ছি। বেনাখালি আসলে দেখি খাল দিয়ে স্রোত বয়ে যাচ্ছে। অনেক মানুষ খালের ভিতর নেমে মাছ ধরছে। খালি গায়ে গর্তের ভিতর হাত দিয়ে শিং, চ্যাঙ ইত্যাদি মাছ ধরছে। আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। মাথার বোঝাটা নামিয়ে খালে নেমে পড়লাম। গর্তের ভিতর হাত দিতেই একটা কিছু ধরে ফেললাম। হাত বের করতে আমার হাত পেঁচিয়ে ধরলো। ভাবলাম বাইন ধরেছি। মুহূর্তেই বিষয়টা পরিষ্কার হল। একটা ধরা সাপের গলার টিপে ধরেছি। সাথে সাথে বাম হাত দিয়ে পেঁচানো ছাড়িয়ে ছুড়ে ফেললাম। একটা মস্ত ধোড়া সাপ। আমি কিছুটা হতবিহ্বল সবাই গর্তে হাত দিয়ে মাছ ধরছে। আমার কপালে কেন সাপ ছুটলো।
পাশ থেকে জ্ঞান বিতরণ করল। পানির নিচের গর্তে মাছ থাকে। আধা পানি আধা বাতাসের গর্তে মাছ খাবার জন্য সাপ থাকে। সারাজীবন মনে রেখেছি। এটাই experiential learning।
মাঠ থেকে গরু গাড়িতে করে খোলেনে (বাড়ির পিছনে উঠান) ধান আনতে হতো। মাঠ থেকে ধান আনার জন্য ক্ষেতে গাড়ীর দু’পাশে গাদা করা হতো যাকে ‘জালি’ দেয়া বলে। এভাবে গাঁদা দিলে গরু গাড়ীতে বোঝাই করা সহজ হয়। আমার জন্য গাঁদা দেয়ার কাজ বাধ্যতামূলেক ছিলো না তবে করতে হতো। এই মওশুমে ধানের ক্ষেতে কেচোর মাটি শুকিয়ে শক্ত হয়ে থাকতো। এছাড়া কাটা ধানের গোড়ার সুচালো আগায় কচি পায়ের আঙুলের গলা কেটে রক্তারক্তি হতো। খলেনে ধান ঝাড়া হত। আমাদের বিপুল পরিমাণ আমন ধান হত। আমন ধানের বিচালির দুইটা বড় বড় গাদা হত। এখনও একইভাবে কাজ হয় তবেন ভ্যান গরু গাড়ীর স্থান দখল করেছে।

গাড়ীতে ধান বোঝাই করার জন্য জালি দেয়া হয়েছে, মাঝে গরু গাড়ী রেখে ধান বোঝাই হয়-২০১৭
বর্ষার মাসে একনাগাড়ে বৃষ্টি থাকতো। আব্বা chainsmoker ছিলেন। বক সিগারেট খেতেন। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সিগারেট টানতেন। একদিন এমনভাবে সিগারেট টানতে টানতে ঘুমিয়ে পড়েছে। হাতে সিগারেট বালিশে পড়ে আগুন ধরে গিয়েছে। হাতের একটি আঙুল পুড়ে সারাজীবন বাকা ছিল। সিগারেটের জন্য কাশির কারণে কখনো কখনো অসুস্থ থাকতেন। বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে রাজগঞ্জের হাট। সপ্তাহে দুদিন হাট বসতো। এই হাট থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হতো। এরকম বড়হাট আরো অনেক দূরে। তাই রাজগঞ্জের হাট থেকেই সকল জিনিসপত্র কেনা হত। তরিতরকারি মাছ-মাংস কেনা হত। যদিও আব্বার সাথে জেলেদের ভালো সম্পর্ক ছিল। তাই জেলেরা বাড়িতে মাছ দিয়ে যেত। যাহোক আব্বা অসুস্থতা কালীন আমাকে হাটে যেতে হতো। হাট থেকে সওদা করে আনতে হতো। বর্ষার দিনে কোন যানবাহন ছিলনা। বাজার করে দুহাতে চটের থলে তে করে বাজার আনতে হতো। শুকনো দিনে সাইকেলে বেঁধে কখনো চড়ে কখনো ঠেলে আনা হতো। এই বাজারের সাথে নিত্য প্রয়োজনীয় কেরোসিন তেল একটি অন্যতম সওদা। একবার কেন, বহুবার কেরোসিন তেল পুঁইশাক বা অন্য তরকারির সাথে হঠাত ঝাঁকায় লেগে যেত। প্রথমে বোঝা না গেলেও মুখের ভেতরে ঢুকলেই কেরোসিনের স্বাদ গন্ধ পাওয়া যেত। তখনই বকা খেতে হত। শুকনো দিনে সাইকেলে করে অথবা পায়ে হেঁটে হাটে যেতাম। পায়ে প্যাডেলের নাগাল না পেলেও ধাক্কা দিয়ে দিয়ে সাইকেল চালাতাম। তখনকার দিনে আজ কালকের মত প্লাস্টিকের বোতল ছিলনা। তাই কাঁচের বোতলে কেরোসিন আনতে হতো। সাইকেলের রডে বাধা কেরোসিনের বোতল মাঝে মধ্যে ভেঙে যেতো। রাস্তায় পই (গরুর গাড়ি চলার জন্য খাদ) কাঁটা ছিল। হঠাৎ বর্ষা হলে খাটের উপরে রাস্তা পিচ্ছিল হতো। পিচ্ছিল রাস্তায় কখনো কখনো সাইকেল খাদে পড়ে তেলের বোতল ভেঙ্গে যেত।
রাজগঞ্জে মেশিনে ধান ভানানো এবং ধান, মসুর বা মুগডাল, কাঁঠাল ইত্যাদি গরু গাড়িতে নিয়ে বাজারে বিক্রি করা হতো। আমাদের বাড়িতে আব্দুল নামের পশ্চিম পাড়ার একটা ছেলে থাকতো। সে আমাদের পরিবারের সদস্যের মত। আমরা তাকে এর বাইরে অন্য কিছু ভাবিনি। মা-বাবা আমাদেরকে সেভাবে গড়ে তুলেছিলেন। তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করলে আমাদের রক্ষা ছিলনা। আমরা কোনদিন তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি এমন কিছু মনে পড়ে না। বরং ভাইয়ের মতো ছিল। যারা এর চেয়ে বেশী বয়সী ছিলো তাদেরকে আমরা সব সময় চাচা বলে ডাকতাম। আবদুল গাড়োয়ান আমি কো-গাড়োয়ান হিসাবে রাজগঞ্জ হাটে গরুর গাড়ি নিয়ে যেতাম। আট-দশ মণ বোঝা নিয়ে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে গরুর গাড়ির ধুরো ভেঙে যেতো। স্পেয়ার ধুলো (দুই চাকার মাঝে ভারবাহী কাঠ) আসা পর্যন্ত রাতে সেখানে থাকতে হতো। কখনো কখনো অতিরিক্ত ধুরো আগে থেকেই সাথে থাকত।
এমনি একদিন ঝড় বর্ষার রাতে ধান ভানে বাড়ি ফিরছি। রাত বেশ গভীর কারণ হাটের দিনে ধান ভানানোর লাইন পড়তো। ধান ভাঙালে কয়েকটি বস্তা খালি হয়ে যেত। পথে বাড়ির কাছে আমবাগ এর কাছে এসে দেখলাম আমতলায় পাকা আম বিছিয়ে আছে। লোভ সামলাতে পারলাম না। খালি বস্তায় আম ভর্তি করলাম। তারপরও গাছতলায় প্রচুর আম থেকে গেল। তখনকার দিনে যত্রতত্র পাকা আম পড়ে থাকত তাই খুটলে কেউ বাধা দিত না। দুর্যোগ উপেক্ষা করে কেউ আম খুটতে আসতো না। গ্রামের বাজারে আম বিক্রি হতে দেখিনি। এখন আমে বেশ দাম। এখনকার দিনে এভাবে আম খোটার কথা চিন্তাই করা যায় না। হয় মামলা না হয় ঝগড়াঝাটি হবে। তখনকার দিনে আম গোটাও চিত্তবিনোদনের একটা অংশ ছিল।