যুদ্ধে ইউক্রেনিয়ান নাগরিকদের কষ্টের সীমা নেই, সেই কষ্ট দেখে ইউরোপিয়ানরা ব্যথিত হচ্ছেন। তারা বলছেন এদের কটা চুল, নীল চোখ আর সাদা শরীর এশিয়ানদের মত না। এরা সভ্য, ইরাক সিরিয়া বা লিবিয়ার কিংবা প্যালেস্টাইনীদের মত না। এরা খ্রিষ্টান যদিও খ্রিস্টান শব্দটি বর্তমান তুরস্কের একটি প্রাচীন শহর এন্তাকিয়ায় (Antioch) গালি হিসেবে উৎপত্তি হয়েছিলো। এদেরকে বাঁচাতে হবে। কেউ কেউ বলছেন এরা অন্য কেউ না ইউরোপিয়ান। আসলেই কি এরা ইউরোপিয়ান? এখানে কি খ্রিস্টান ছাড়া অন্য ধর্মের মানুষ ছিল না? যদি থেকে থাকে তবে তারা কোথায় গেল? আমরা ইতিহাস থেকে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করব। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে এরা আসলে মিশ্র, বংশগতির সিংহভাগ এশিয়ার। তবে কখন থেকে হিসাব করা হচ্ছে তারই উপর নির্ভর করছে ফলাফল। যারাই হোক এরা মানুষ এদের দুঃখ কষ্ট অন্য ধর্মের অন্য মহাদেশে মানুষের মতোই।

আজ থেকে প্রায় সাত হাজার চারশ থেকে চার হাজার সাতশ বছর আগে বর্তমান ইউক্রেনের উত্তর পশ্চিম দিকের পেরিপিট (pripet) জলাভূমির ট্রিপিলিয়া (Trypillia) সংস্কৃতি থেকে স্লাভ জাতির উৎপত্তি। এই এলাকার উইন্ডিজ (wends) উপজাতি মৎস্য শিকার ছাড়াও জুম চাষ ঘোড়া শুকরসহ অন্যান্য গবাদি পশু পালন করার ফলে ব্যাপক জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়। এরাই খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত বর্তমানের পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, ইউরোপিয়ান রাশিয়া ও ইউক্রেন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। উয়েন্ডিজ এর একটি গোত্র এনটিস (Antes) বর্তমান ইউক্রেনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কালক্রমে ইউক্রেনের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই জাতিগোষ্ঠীর কিছু মানুষ বলকান এলাকায়ও অভিবাসন করে। এইভাবেই প্রথমে যাযাবর তারপর কৃষিজীবীতে রূপান্তরিত হয়। এদেরকে ইউক্রেনীয়দের পূর্বপুরুষ বলা যায়।
ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগর উপকূল এলাকায় ১৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ইন্দো-ইরানীয় সিমেরিয়ান জাতি বাস করতো। সিঁথিয়ানরা ৮০০-৪০০ খ্রিস্টপূ্র্বাব্দের দিকে পশ্চিম দিকে তাদেরকে বিতাড়িত করে। এদের একাংশ ইউক্রেনের আন্টিজদের সাথে মিশে যায়। ৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে শেষ দিকে ইউক্রেনের দক্ষিনে কৃষ্ণসাগর (Black sea) উপকূলে বেশ কিছু গ্রীক নগর রাস্ট্রের শুরু হয়। ইন্দো-ইরানীয় সারমাতিয়ানরা ৫০০ থেকে ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বদিক থেকে এসে সিথিয়ানদের পশ্চিম দিকে বিতাড়িত করে। সারমাথিয়ান কুমারীদের বিবাহের আগে অন্তত ৩ জন পুরুষ হত্যা করে বিবাহযোগ্যা হয়েছে মর্মে প্রমাণ করতে হতো। এরাই ট্রয় যুদ্ধে সেই বিখ্যাত আমাজন নারী। এই দেশ নারীরা শাসন করতো। এদের নাম অনুসারেই দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন বনভূমি নামকরণ করা হয়েছে।
২৩৮ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম দিক থেকে বাল্টিক সাগরের বর্তমান সুইডেনের গোটল্যান্ড দ্বীপ এলাকা থেকে নরডিক গথ নামে কিয়েভান রুশদের পূর্বপুরুষ বর্তমানের ইউক্রেনের এলাকায় এসে সারমাতিয়ানদের আধিপত্য খর্ব করে। সারমাতিয়ানরা ইউক্রেনের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং ইউক্রেনের স্লাভদের সাথে মিশে যায়।

তুর্কিদের পূর্বপুরুষ হুন চিনদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত ও বিতাড়িত হয়ে ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমে অভিবাসীত হয়ে ইউক্রেন এলাকায় গথদের পূর্ব অভিমুখে সম্প্রসারণ রুদ্ধ করে দেয়। হুন আক্রমণে ভীতসন্ত্রস্থ সারমাথিয়ান, গথ, এলান, ভ্যান্ডাল পশ্চিমাভিমুখে পলায়ন করে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে আশ্রয় প্রার্থনা করে। এদের একাংশ জার্মান, ফ্রান্স, স্পেন থেকে জিব্রাল্টার প্রণালী পার হয়ে আফ্রিকা মহাদেশের উপনীত হয়। কালক্রমে বর্তমানে তিউনিসিয়া অর্থাৎ কার্থেজ রাজ্য দখল করে। এখানে ১০০০ খ্রিস্টপূর্ব আগেই ফিনিশিয়ান অর্থাৎ লেবানিজরা রাজ্য স্থাপন করেছিল।

তুর্কি আশিনা উপজাতির বুমিন খান ৫৪৬-৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মানচুরিয়া থেকে ইউক্রেনের মাওতিন সাগর (বর্তমানে আজভ সাগর) পর্যন্ত রাজ্য স্থাপন করে। তুর্কি আভার উপজাতি ৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে বুমিন খানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ইউক্রেন এলাকায় পালিয়ে আসে। বুমিন খান এদেরকে ফেরত দিতে বললেও বাইজেন্টাইন সম্রাট অস্বীকার করে। গৃহযুদ্ধ, চিনা ট্যাং সাম্রাজ্যের আক্রমনে ওই তুর্কি সাম্রাজ্য ভেঙে যায়। দলে দলে মানুষ ফসলের জন্য উপযুক্ত ইউক্রেন এলাকায় এসে রাজ্য ও বসতি স্থাপন করে। তুর্কিদের আরেকটি উপজাতি বুলগার ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ইউক্রেন এলাকায় এসে রাজ্য স্থাপন করে। এদের একাংশ পশ্চিম দিকে রাজ্য স্থাপন করে যা এদের নাম অনুসারে বুলগেরিয়া নামকরণ হয়েছে। অপর অংশ রাশিয়ার কাজান এলাকায় গিয়ে রাজ্য স্থাপন করে। পূর্ব দিক থেকে খাজার নামের আরেকটি তুর্কি উপজাতি এসে বুল্গারদের ৬৬৮ সালে পরাজিত করে রাজ্য স্থাপন করে যা ৯৬৫ সাল স্থায়ী হয়। এই সাম্রাজ্যের অনেকেই ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করে। বর্তমানের ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ইহুদি ধর্মাবলম্বী ভ্লদিমির জেলেনস্কি সম্ভবত এদেরই বংশধর। অপর একটি তুর্কি ম্যাগিয়ার উপজাতি উরাল এলাকা থেকে ইউক্রেনে অভিবাসিত হয়। আরেকটি তুর্কি পেসনিক উপজাতি ৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে খাজার সাম্রাজ্য বিধ্বস্ত ও দখল করে খাজার ও ম্যাগিয়ারদের পশ্চিমদিকে বিতাড়িত করে।
সুইডেন এলাকা থেকে ৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ভাইকিংদের দুই ভাই অসকাল এবং দির নিপার নদীর তীরে কৌশলগত স্থান বর্তমানে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে দখল করে রাজ্য স্থাপন করে। ৮৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রিন্স ওলেগ দিরকে হত্যা করে ইউক্রেনের কিয়েভ দখল করে। রুরিক রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে। স্বর্ণ যুগের সূচনা করে। ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ভ্লাদিমির দি গ্রেড কিয়েভকে রাজধানী করে কিয়েভান রুশ সমরাজ্য স্থাপন করে। ৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে খ্রিস্টান ধর্ম রাজ্য স্থাপন করে। এরোস্লাভ দ্যা ওয়াইজ ১০১৯-১০৫৪ শাসনামলে কিয়েভ পূর্ব ইউরোপের প্রধান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। কিউম্যান কিপচাক তুর্কি উপজাতীয়রা ১০৫০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ইউক্রেনে এসে বসতি স্থাপন করে।
১২৩৭ থেকে ১২৪০ চেঙ্গিস খানের মঙ্গল-তাতার বাহিনী কিয়েভ রাজ্য ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। এখানেই চেঙ্গিস খাঁর প্রথম পুত্র জসি খান গোল্ডেন হোর্ড বা সোনালী তাঁবুর রাজ্য স্থাপন করে। যোশির ছেলে বারকি খান মুলমান ধর্ম গ্রহণ করে। মুসলমানরা ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৫৪৬ বছর দেশ শাসন করে। এই ইউক্রেন এলাকা থেকেই প্রগৈতিহাশিক কাল থেকে দাস সংগ্রহ করা হতো। সেই সূত্রে হুররাম সুলতান অটোমান সুলতান সোলায়মান এর স্ত্রী হয়েছিলেন। অটোম্যান সম্রাটদের অনেকেই এই এলাকায় তাদের শ্বশুরবাড়ি করেছেন যেমন সুলতান সেলিম, সুলতান সোলায়মান, শাহজাদা মুস্তাফা ইত্যাদি।
১৩৪৯-১৪৩০ পর্যন্ত পোলিশ লিথুনিয়ান কমনওয়েলথ পশ্চিম ও উত্তর ইউক্রেন দখল করে নেয়। ১৪৪১ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ান খানেত ইউক্রেনের দক্ষিণ অঞ্চল দখল করে গোল্ডেন হোর্ডে সাম্রাজ্য ভেঙে ক্রিমিয়ান খানেত সৃষ্টি হয়। ১৬৪৮-১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে পোলিশ লিথুনিয়ান কমনওয়েলথ এর বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় কোসাক বিদ্রোহ ঘোষণা করে কোশাক হেটম্যানেট প্রতিষ্ঠা করে। কোশাক হেটম্যানেট আধুনিক ইউক্রেন রাষ্ট্রের প্রাথমিক ভিত্তি।
১৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ান জার কোশাক হেটম্যানের রাজ্যে গ্রাস করার জন্য ‘ট্রিটি অফ পেরিয়াসল্যাভেল’ চুক্তি করে। ১৬৮৬ সালে রাশিয়া এবং পোল্যান্ড “ট্রিটি অফ পারপিচুয়াল পিচ” চুক্তির মাধ্যমে অটোমানদের সাথের ৩৭ বছরের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়। পোল্যান্ড এবং রাশিয়া এই সুযোগে কোশাক হেটম্যানেট ভাগ করে নেয়। ১৭০৮-৯ খ্রিস্টাব্দে ইভান মাঝেপ্পা রাশিয়ার করাল গ্রাস থেকে পূর্ব কোশাক হেডম্যানেট মুক্ত করার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করে। রাশিয়ান জার ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব কোসাক হেডম্যানেট বিলুপ্ত করে লিটল রাশিয়া গভর্নরেট অতঃপর ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে সাম্রাজ্য ভুক্ত করেন। ১৭৭২-৯৫ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ানরা পোলাণ্ডকে ভাগ করে পশ্চিম কসাক ইউক্রেনও রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া ক্রিমিয়ান খানেতসহ দক্ষিণ ইউক্রেন দখল করে।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ান সাম্রাজ্য ভেঙে গেলে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯২১ সালে কমিউনিস্টরা ইউক্রেনের দুই-তৃতীয়াংশ দখল করে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করে বাকি অংশ পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত থাকে। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে নাজি-সোভিয়েত চুক্তির মাধ্যমে পোল্যান্ডের অধীনে থাকা পশ্চিমের অংশ সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করে নেয়।
১৯৪২-১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইউক্রেন নাজি জার্মানির অধিকারে থাকা অবস্থায় ৫০ লক্ষ ইউক্রেনিয়ানকে হত্যা করে যার মধ্যে প্রায় ১৫ লক্ষ ইহুদি। স্ট্যালিন ১৯৪৪ সালে ২ লক্ষ তাতার মুসলিমকে সাইবেরিয়ায় ও মধ্য এশিয়ায় নির্বাসনে পাঠায় এদের অনেকেই অনাহারে এবং শীতে মারা যায়। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে ২ লক্ষ ৫০ হাজার প্রিমিয়াম তাতারকে ইউক্রেনে আসার অনুমতি দেয়। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
এরপর ২০১৪ সালে পুনরায় রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে। দনেক্স ও লোহানস্ক রাশিয়ান বিদ্রোহীদের দিয়ে দখলে রাখে ও পরবর্তীতে স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষের স্বীকৃতি দেয়। এরপর ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে ফেব্রুয়ারি পুনরায় ইউক্রেন দখলের চেষ্টা করে যে যুদ্ধ এখনো অব্যাহত আছে। বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ইউক্রেন থেকে ইউরোপের দিকে আশ্রয় নিচ্ছে। পশ্চিম ইউরোপের অনেকেই তাদেরকে কটা চুলের অধিকারী ইউরোপিয়ান বলে দাবি করছে। তারা বলছে এরা সভ্য এরা মুসলমান না এরা আরব না সুতরাং এদের কে বাঁচাতে হবে। উপরের তথ্য থেকে কি মনে হলো এরা সবাই ইউরোপিয়ান বা বেশিরভাগ ইউরোপিয়ান রক্তের অধিকারী? এখানে কে আগাগোড়াই খ্রিষ্টান ছিল?
কন্ট্রিবিউশন: এম আই খান