তিন বছর শিবালয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলাম। অনেক experiment করেছি অনেক, অনেক experimenter বিষয়বস্তু হয়েছি। বর্ষার দুর্বার স্রোত ছাড়াও ঋতু পরিবর্তনের সময় দমকা হাওয়ায় যমুনায় লঞ্চডুবি হতো। চির জীবনের একটা অদম্য কৌতূহল না জানা কে জানা। একবার লঞ্চডুবিতে যাত্রীসহ লঞ্চ নিখোঁজ হল। একটা লঞ্চে নিখোঁজ যাত্রীর খোজে যমুনা বেরিয়ে পড়লাম। তখন আরিচায় লঞ্চঘাট। আরিচা এখনকার পাটুরিয়া ঘাট থেকে সাত আট কিলোমিটার উজানে। আমি ডাংগা এলাকার মানুষ। চাকরীর সূত্রে মাদারীপুর টুংগিপাড়া নদী এলাকায় কাজ করেছি। নদী থেকে কখনো লোকালয় কিম্বা ক্ষয়ে যাওয়া গ্রাম দেখিনি। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার কাশবন দেখিনি। ৩৫ মিলিমিটার ফিল্মের মত ভেঙে যাওয়া পাড় দেখিনি। আরিচা থেকে চরভদ্রাসন চষে বেরিয়েছি, কোথাও কোন লঞ্চের চিহ্ন নেই। জীবন তো দূরে থাক লাশের চিহ্ন নেই। শুধু ঘোলা পানির ঘূর্ণি। পানির গতিকে শ্লথ করে পলি ধরার ফাঁদ পাতা কাশবন। এ যেন সকালের বাংলার গ্রামে কেউ ঘুমিয়ে আছে, কেউ অলস জড়তা কাটাচ্ছে, আবা কেউ ত্রস্ত পদে এগিয়ে চলেছে সমুদ্র পানে। বেলা গড়িয়ে সন্ধা, খালি হাতে ফেরার পালা। উজানের পানির তোড়ে লঞ্চের ইঞ্জিন কাটিয়ে উঠতে পারছে না।
ছাতা না জীবন কোনটার দাম বেশি:
জাফরগঞ্জ হাট, হাট-বাজার করে রওনা দিয়েছে চরের উদ্দেশ্যে। নৌকায় করে যাচ্ছে কোন একটা চরে, সাথে বাজারের ব্যাগ বগলে ছাতা। নৌকা ছাড়তেই বগলের ছাতা নদীতে পড়ে গেল। চরের মানুষ নদীর স্রোতের চরিত্র যে জানে না তা না। তবু আশা ছাতাটাকে পেতে হবে, নইলে টাকা গুনতে হবে। মনের সব সময় জীবনের আশা থাকে, তার হয়তো তাই ছিল। সাথে সাথে ঝাঁপ দিল নদীতে। নদীতে প্রবল ঘূর্ণি, ঘোলা পানিতে এক ইঞ্চি নিচে দেখার জো নেই। মুহূর্তে কাউকে ছাতা দেখার জো থাকলো না। কত প্রকল্প, কত পরিকল্পনা, কত সাহায্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু তার মত মানুষদের বাঁচানোর জন্য আমাদের সাংসদরা এখনো কোনো আইন বানাতে পারেনি। কোন প্রকল্প বানাতে পারেনি যেখানে লাইভ jacket চরের মানুষদের জন্য দেয়া হবে এবং jacket পরতে বাধ্য করা হবে। প্রশ্ন করবেন লাইফ জ্যাকেট দিলেই কি ব্যাবহার করবে, নৌকা ছাড়ার সময় যাত্রীরা পরবে? সবই সম্ভব।
নৌপরিবহন আইনে পরিবর্তন এনে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে নৌকায় live জ্যাকেট রাখতে বাধ্য করা যায়। ইউনিয়ন পরিষদ এ কাজটি করল কিনা উপজেলা নির্বাহী অফিসার কে তদারকি করার দায়িত্ব দেয়া যায়। এবং না করলে জরিমানা করার ক্ষমত দেওয়া যায়। কিম্বা পুলিশকে এ ক্ষমতা দেয়া যায়। কিম্বা মোবাইল কোর্টকে এই ক্ষমতা দেওয়া যায় কিংবা একই সাথে সকলকে ক্ষমতা দেওয়া যায়।
বন্যার চর:
চারদিকে ঘোলা পানির স্রোত তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সাদা ধূসর শাড়ি পরা বিধবা। সামনে দিগন্ত বিশাল বিস্তৃত। শরীরে ঠাণ্ডার কাপুনি। তার উপর বাতাসের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। সেবারের বর্ণনাটা একটু বেশি। সরকারের আশ্বাস আছে রিলিফের। কিন্তু চরে টাকা দিয়ে সবকিছু হয়না। টাকা থাকলেও পণ্য নেই তাই কেনার সুযোগ নেই।
লঞ্চ মালিকদের সাথে পরস্পর বোঝাপড়া ভালো ছিল। তারা অর্থশালী। ইতিমধ্যে তারা আমার উপর আস্থা পেয়েছে। আমি আর আমার steno আলিম আরিচা ঘাটে গিয়ে লঞ্চ জোগাড় করে ফেললাম। লাল হলে তা হবে না, কথায় চিড়ে ভেজে না। চরের মানুষদের বন্যায় দেখতে গেলে চিড়া আর গুড় নিতে হবে যেতে হবে। আরিচায় চিড়ার মিল আছে, আখের গুড়ের অভাব নেই। চিড়া আর গুড় দিয়ে লঞ্চ ভর্তি করলাম। রওনা দিলাম চরের উদ্দেশ্যে। শীতের দিনে 45 মিনিটের লঞ্চ যাত্রা বর্ষায় একটু বেশি। যে দেখলাম চরবংশী বাড়িঘর ভেঙে যাচ্ছে। শুরু করলাম গুড়া চিড়া দেওয়া। এভাবে রাত আসলো তারপর আবার দিন একই কাজ এভাবে দুই দিন দুই রাত কেটে গেল। জেলা প্রশাসক আমাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই পুলিশের একটা দিন কে পাঠিয়ে দিয়েছে। তখনকার দিনের মোবাইল ফোন আসেনি। দেখলাম এক জায়গায় একজন মহিলা কোমর পানির মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে পানি ছাড়া আর কিছু নেই। এগিয়ে গেলাম লঞ্চে ওঠালাম জিজ্ঞাসা করলাম এখানে কিভাবে আসলেন। বলল আসেনি, ছিলাম, বাড়িঘর সবই চলে গেছে। আল্লাহ আমাকে নেয়নি। স্বামী নাই, পুত্র-কন্যা নেই, ছিল শুধু ঘর তাও চলে গেছে। আমিতো স্রোতে যেতে পারি না, নৌকায় যেতে পারি কিন্তু নৌকা নেই তাই এখানে। যদি ঘুম হয়নি, খাওয়া হয়েছে এক রকম। মনে হল জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আবার মনে হল আমি স্বর্গে থাকি কেন হতাশ হব? কেন তা চালিয়ে যাবনা? কেন কম তাই? কেন কাবিখা কাবিটা খাব? কেন এদের জন্য একটা প্রকল্প বানাব না। এদের যদি টাকা থাকতো তাহলেই চর, এই বন্যা, এই ঘোলা পানি, আনন্দের বিলাসিতার, আর উপভোগের হত। একটা প্রকল্প করে community পর্যটন করা যেত। যেখানে বর্ষার দিনে ঘোলা পানি দেখার জন্য মানুষ আসতো। কিভাবে ব্যাংক দিয়ে বোয়াল মাছ ধরতে হয় demo করানো যেত। কিভাবে স্রোতে ভেসে থাকতে হয় তা দেখানো যেতো। শরতের দিনে সূর্য ডোবা দেখানো যেতো। কিভাবে শামুকের ভিতরের অংশ দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরা হয় দেখানো যেত।
একটি চর একটি পর্যটনকেন্দ্র:
চরের লাল চালের ভাত বোয়াল মাছের ঝোল ভরা দুপুরে খাওয়া যেত। শীতের শেষে গরমের আগমনে রুপার টুকরোর মতো ভেসে ওঠা চরে ভলিবল খেলা যেত। swimming নডিউল দিয়ে সাঁতার কাটানো যেতো। নদীর ঠান্ডা পানিতে গরমের দিন গা জুড়িয়ে যেত। একটি চর একটি পর্যটন কেন্দ্র। যেখানেে বিধবারা প্রশিক্ষণ শেষে রাধুনী হত। কিংবা housekeeper হত কাপড় চোপড় পরিষ্কার করে দিত। তাদের একটা emergency নৌকা থাকতো। চরে বসে টমেটো লাগাতো। এ চরের বালির ভিতরে সবজি ফলাতো। এক সময় তারা চর থেকে দূরে গিয়ে বাড়িঘর করত, চর থেকে দূরে থাকত। নিরাপদ থাকতো। চর পর্যটন কেন্দ্রে, কর্মক্ষেত্রে পরিণত হতো। আবার হয়তো কাজের কাছেই বাড়ি করার জন্য ফিরে আসত। এই বাড়ি সেই বাড়ি না। এই বাড়ি অনেক উন্নত ও আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত। একটি চর একটি পর্যটন কেন্দ্র। একটি চর একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র। একটি চর একটি আদর্শ। কবে হবে সেই দিন? সেই দিনের জন্য আমি না থাকলেও আপনি থাকবেন এই আশা করে।
চরো গালির অবসান:
এ স্টেশন রেলের ও না, বাসের ও না, নৌকার, নৌযানের। চরে চরে নৌকার station থাকতো, কোন প্ল্যাটফর্ম থাকত না, কোন ইট নেই, পাথর নেই, গাথনি নেই। আছে কাঠের সিঁড়ি। নৌকার সামনে সিঁড়ির ধাপ। চর থেকে চরের, চর থেকে পাড়ের, পাড় থেকে শহরের network. প্রথমে একটা প্রকল্প ১ বছর ২ বছর চলবে। তখন সরকারকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। দু’বছরে পূর্ণতা পাবে। চর দিয়ে বিদেশ যাবে, immigration center হবে। শখ করে চর দিয়ে, নদী দিয়ে, ভেসে যাবে। চরে প্রতি দৃষ্টি পড়বে, নিত্য নতুন খবর কাগজের ছাপবে। সবাই চরমুখি হবে। চর নিয়ে ভাববে। চরো বলে গালি দেবে না।