সংস্থাপন বর্তমানের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে আদেশে উপজেলায় ম্যাজিস্ট্রেট টুংগীপাড়া হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। জীবনের প্রথম মাদারীপুর থেকে টেকেরহাট হয়ে বাসে গোপালগঞ্জে পৌঁছাই। পরবর্তীতে যশোর থেকে বাসে খুলনায় এসে সন্ধ্যায় লঞ্চে উঠে সকালে পাটগাতি ঘাটে লঞ্চ পৌঁছাই। এছাড়াও যশোর-ফরিদপুর হয়ে টেকেরহাট থেকে বাসে গোপালগঞ্জ আসা যেতো। অনেকবার এই রাস্তায় এসেছি। গোপালগঞ্জ এসে মাদারীপুরের মতোই জেলা পরিষদের ডাক বাংলোয় উঠলাম। যোগদান করার পর একই বিড়াম্বনা জেলা প্রশাসক উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সদর এর সাথে কোর্টে বসে বিচার কাজ শিখে নিতে বললেন। খবর নিয়ে জানলাম তার খুব একটা সুনাম নেই। তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক; রাজনীনৈতিক নেতাদের সাথেও সৌহার্দ্য ছিল। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম কিছুতেই তার সাথে বসবো না। কোর্টে বসলে উকিলরা আমাকে understimate করবে। আমি তার মতোই টুঙ্গিপাড়ার উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট, হতে পারি বয়সে কম। তখন থেকেই শেখার চেষ্টা করেছি। আমি এখনো মনে করি এসব বিষয়ে সবচেয়ে ভালো জবাব ভালো করে শেখা।
টুঙ্গিপাড়ায় তখন বঙ্গবন্ধু ভবন ছাড়া আর কোনো পাকা ঘর নেই। সরকারী অফিস নেই, সদ্য নির্মাণ করা সমাজ সেবা কমিউনিটি সেন্টারে কোনরকম উপজেলা নির্বাহী অফিস চলে। তাই উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট ক্যাম্প-এট গোপালগঞ্জ অর্থাৎ টুংগীপাড়া উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট গোপালগঞ্জে বসবে। ডিসি অফিস একটি কক্ষ কোর্ট করার জন্য বরাদ্দ দেয়া হলো। বিগত জেলা প্রশাসক খলিলুর রহমান এর সময় এই ভবনটিকে জাদুঘর করা হয়েছে। এই ভবনের একটি কক্ষে টুঙ্গিপাড়ার কোর্ট বসতো।
বরাবরের মতো আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন। জেলা প্রশাসক মহোদয় আমাদেরকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়ার সকল প্রচেষ্টাই করেছেন। যদিও আমার চেয়ে অন্যরা প্রাধান্য বেশি পেতো। কিন্তু জেলা প্রশাসক মহোদয়ের জুনিয়রদের শেখানোর সকল প্রচেষ্টাই নিতেন। আমাদেরকে বই দিয়ে পড়তে বলতেন এবং সপ্তাহে একদিন প্রেজেন্টেশন করতে বলতেন। আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো লিখে রাখতে বলতেন। নোটপ্যাড আর কলম ছাড়া তার সামনে গেলে বকুনি দিতেন। এটি একটি সাধারণ বিষয় মনে হলেও আমার জন্য একটি বড় ধরণের শিক্ষা। পরবর্তী জীবনে আমি অন্যদেরকেও শিখিয়েছি। আমার কাছে কেউ কাগজ কলম ছাড়া আসলে আমি খুবই বিরক্ত হই। কিন্তু নিজেই এখন কাগজ-কলম ছেড়ে দিয়েছি মোবাইল ফোনে সব কাজ সারি। তিনি আইন পড়তে বলতেন। কিভাবে নোট করতে হয় বোধকরি জেলা প্রশাসকরা তাদের সদ্য যোগদানকৃত সহকর্মীদের শেখাতে পারেন।
জেলার ফৌজদারী বিচার সম্পর্কে বিবরণী দিতে হতো। সাতটি বিবরণী ফরম এবং ১২ টি টেবিলে এগুলোতে সবকিছু cover করত। কিন্তু এই স্টেটমেন্ট তৈরি করার মত অভিজ্ঞতা তখন কারও ছিলোনা। আমি নবীন, আমার কোন অভিজ্ঞতা ছিলনা। কিন্তু পিছপা হলাম না। উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব ছাড়াও আমাকে জুডিশিয়াল মুন্সিখানা দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। স্বভাবতই আমার ঘাড়ে এই বিবরণী তৈরির দায়িত্ব আসে। আমি নেমে পড়লাম, রীতিমত গবেষণা শুরু করলাম। এই কাজ করা অবসরপ্রাপ্ত মানুষদের সাথে আলোচনা করলাম। এক পর্যায়ে এগুলো তৈরি করে ফেললাম, পাঠিয়ে দিলাম হাইকোর্টের। এই অভিজ্ঞতা জীবনে কখনো ভুলবো না। এরপর বিসিএস প্রশাসন একাডেমিতে ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছি। অনেক সময় তাদেরকে হাতে কলমে কাজ দিয়েছি। কেউ কেউ বলেছেন স্যার আমি তো কখনোই এসব করিনি কিভাবে করব। আমি তাদেরকে বলছি বিয়ে করেছ? বিয়ে করার আগে কি একটি টেস্ট বিয়ে করবে,? বোঝাতে চেয়েছি অনেক কাজে অভিজ্ঞতা না থাকলেও করা সম্ভব। চেষ্টা করতে হবে অভিজ্ঞতা নেই তাই করা যাবে না এটা সঠিক না। এখানে যে শিক্ষা পেয়েছি সারাজীবন তা ব্যবহার করেছি, ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করেছি। এগুলি আমার সারা জীবনের পাথেয় হয়েছে। জেলা প্রশাসক এহিয়া চৌধুরীর কথা ভোলার না। উনার সাথে এখনো দেখা হয়, কথা হয়।
গোপালগঞ্জে প্রথম পৌঁছে জেলা পরিষদের ডাক বাংলোয় থাকা শুরু করেছি। এখানকার পানিতে খনিজ পদার্থ অত্যন্ত বেশি এবং টিবওয়েলের পানি সরাসরি খাওয়া যায় না এ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালীন টিউবওয়েলের পানি খেতাম তাই এখানে এসে সেই অভ্যাসটা বাদ দিতে পারিনি। টিবওয়েলের পানি খাওয়ার সাথে সাথেই ডায়রিয়া শুরু হয়ে গেল। একের পর এক চলতে থাকল। টাকা পয়সা নিঃশ্বেস। প্রথমে এসেই কারো কাছে টাকা পয়সা চাওয়া ঠিক না সেটা বুঝি। অগত্য নাজির এর কাছে ধর্ণা দিতে হল। সে যাত্রা রক্ষা পেতে না পেতে শুরু হল চোখ ওঠা। এভাবে দিন গুলো চলছিল।
একই বাংলাতে আসলাম আলম যিনি পরবর্তীকালে ব্যাংকিং সচিব হয়েছিলেন, উজ্জ্বল বিকাশ দত্ত যিনিও সচিব হয়েছিলেন এবং জমির উদ্দিন আহমেদ আমেরিকাতে চলে গিয়েছিলেন। আমরা সবাই একই বাংলোতে থাকতাম। ডাক বাংলোর সামনে রাস্তার পর জলাভুমি তার ওপরে ফাকা মাঠ, পানি জমার কারণে সেখানে কৃষি কাজ তখনো হতো না। এখন সেখানে বাড়িঘর রীতিমতো শহর গড়ে উঠেছে। কয়েকটি সরকারি অফিস-আদালত stadium গড়ে উঠেছে। লোকালয় গড়ে উঠেছে। আমাদের ডাকবাংলার পিছন দিকে আনসার ক্যাম্প তার পাশেই খাল এইখান থেকেই নৌকায় করে টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়া যেত। আমরা শুনেছি বেশ আগে এই খালের সাথে সামনের জলাভুমির সংযোগ ছিল আর জলাভুমি তখন নদীর অংশ ছিল। এখন এই মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে শুধু একমুখী চলাচল। এখন গেলে আপনি দেখবেন সেই খাল দিয়ে নৌকা চলে না। সবকিছু ভরাট হয়ে গেছে। ডাকবাংলার পিছন থেকে নৌকায় উঠে আমরা চার বা পাঁচ ঘন্টায় টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছাতাম। মাঠের পর মাঠ গভীর পানির ধান। নৌকায় বসে তাকালে মনে হয় কে যেন রাস্তা বানিয়ে গেছে পাশে ধানের গাছ মাঝ খান পরিষ্কার। কোথাও কোথাও শাপলা ফুটে আছে। আরও কত রকমের জলজ উদ্ভিদ, তার মাঝ দিয়ে পানিতে সাবলীল ভঙ্গিতে চলছে মাছ, কেউ বা জাল পাতছে বা তুলছে। টুঙ্গিপাড়ায় মাঝি পেয়ে বঙ্গবন্ধুর কথা জিজ্ঞাসা করতাম। অগাধ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা লক্ষ্য করেছি। কেউ তার সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তারা তাৎক্ষণিক উত্তর দিত। সবাই বলে গোয়াল দোরের ঘাস গরু খায় না। কিন্তু আমি বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে খেতে দেখেছি। পরবর্তীকালে পুলিশ রিপোর্ট পড়ে কিভাবে তিনি এটি অর্জন করেছেন তা কিছুটা উপলব্ধি করেছি। ততদিনে আমার public life শেষ তাই আমি কাজে লাগাতে না পারলেও পরবর্তী প্রজন্মকে বলছি শেখাচ্ছি। একি বাংলাতে আমরা দুজন munsef ভাইকে পেয়েছি যাকে এখন সহকারি জজ বলে। একজন ভাবিকে নিচের তলায় শুয়ে উপরের তলায় থাকতেন। আমার স্ত্রী সহ আমরা এক রুমে থাকতাম। munsif লাইব্রেরী রুমে থাকতেন। তখনো বিচারকরা ক্ষমতা দেখাতেন। কিছুদিন আগে খবরের কাগজে দেখলাম বঙ্গবন্ধু যমুনা ব্রিজের ওখানে টোল চাওয়ায় একজন ইঞ্জিনিয়ার কে হাজতে দেয়া হয়েছে। বিমান বোর্ডের মেম্বার হয়ে জেনেছি ইকনমি টিকিট থাকলেও বিজনেস ক্লাসের আসন দিতে হয়। রেলের এমন ঘটনা আমরা খবরের কাগজে দেখেছি। সার্কিট হাউজের কথা নাই বললাম। কিন্তু আমাদের সাথে এই জজ সাহেবদের আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। আবুল হোসেন মুন্সী ভাবির কাছে আমরা বাইন মাছ খাওয়া শিখেছি। খুব সুন্দর করে রান্না করতেন। ব্রহ্মপুত্র নদীর ধারের ময়মনসিংহের মানুষ। গোপালগঞ্জ খানিক দূরে হলেও খাওয়া-দাওয়ায় অনেক মিল আছে। কয়েক দিন আগেই শুনেছি সেই ভাই মারা গেছেন। ভাবির সাথে আমার মিসেসের কথা হয়েছে। ভাই-ভাবি দুজনেই বয়েসে একটু বড় ছিলেন। আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব জ্ঞানের অধিকারী। তার কাছে নির্বাচন কিভাবে হয় শুনেছি। তার কাছে নির্বাচনের পর ভোট কাটাকাটির মামলা ছিল। ভোটের পর মামলা হলে কিভাবে সিলগালা করা বস্তার মুখ অবিকল রেখে পিছনের দিকে খুলে সীলদেয়া ব্যালট ঢুকিয়ে ফল পাল্টিয়ে দেওয়া যায় সে সম্পর্কে জেনেছি। এসবই পরবর্তী জীবনে কাজে লাগিয়েছি তবে নেতিবাচক নয় ইতিবাচকভাবে।