লেখাপড়ার জন্য আমার মায়ের প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। আমার মা লেখাপড়া করার সুযোগ পায়নি। তাই আমাদের মাধ্যমে সেই অভাব পূরণের চেষ্টা করেছিলেন। আমি ভাইবোনদের মধ্যে দ্বিতীয়। আমার বড় বোনকে স্কুলে পাঠানোর পর আমার পালা। প্রাইমারি স্কুলের বয়স ৬ বছর হওয়ার আগেই বড়বোনের সাথে স্কুলে যাওয়া-আসা করতাম। ভর্তি হওয়ার আগে আমার প্রথম স্কুলে দিনটি খুব সুখকর ছিল না। ছোটবেলায় আমার পেট খারাপ লেগেই থাকত। আর বর্ষা কালের আদ্র স্যাঁতসেতে পরিবেশ হলে তো কথাই নেই। স্কুলের প্রথম দিনে, তখনো ভর্তি হয়নি ক্লাসরুমে পায়খানা করে ফেললাম। একেতো অছাত্র তারপরে ক্লাসরুম নোংরা করা। শিক্ষক ক্ষেপে গেলেন। অন্যান্য শিক্ষকদের ডাকলেন। তারপর আমার বোনকে পায়খানা পরিষ্কার করতে বললেন। বোন বাধ্য হয়ে সেটা করলেন। এ কথাটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। তবে তার দু’চার বছর পরের কোন কথাই মনে নেই।
শুরুটা সুখকর না হলেও বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরের প্রাইমারি স্কুলে বেশ মনের সুখেই আসতাম। এক এক ক্লাশে দশ-বারো জন করে শিক্ষার্থী ছিল। তখনকার শিক্ষার্থীরা এখনকার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের তুলনায় বয়স্ক ছিল। মেয়েরা প্যান্ট আর ফ্রক বড় হলে পাজামা কামিজ এবং ছেলেরা ঢোলা হাফপ্যান্ট পরে ক্লাসে আসতো।
স্কুলে ফুলের বাগান:
সে সময় স্কুলে ফুলের বাগান ছিল। মস্ত বড় টগর গাছে সারা বছর সাদা ফুল ফুটে থাকতো। ছাত্রদের বাড়িতে ফুলের বাগান করার জন্য বাধ্য করা হতো। আমি এবং আমার বোন বাড়ির নিচে বালের পাড় ঘিরে আলাদা দুটি ফুলের বাগান করেছিলাম। পেঁয়াজ ফুল দিয়ে বাগানের সীমানা দেয়া হতো। কম যত্নে লাল সাদা পেয়াজ ফুল ফুটে থাকতো। গ্রামে এখন পেঁয়াজ ফুল খুঁজে পাওয়া যায় না। কচা গাছ দিয়ে ফুল বাগানের বেড়া দিয়েছিলাম। কিন্তু গ্রামে কেন গোটা উপজেলায় এখন আর কচা গাছ চোখে পড়ে না। কচা গাছের জান খুব শক্ত। কেটে লাগালেই হল। ডাল কেটে মাসের পর ফেলে রাখলে জ্যান্ত থাকতো। অর্থনৈতিক উপযোগিতা না থাকায় কচা গাছ উধাও হয়ে গেছে। সেকালের বেড়া দেওয়ার জন্য উপযুক্ত গাছ। কোথাও কেটে গেলে এর আঠা দেয়া হতো। তবে কাপড়ে লাগলে স্থায়ী দাগ পড়ে যেত। বাগান করার জন্য গাছ লাগানো সম্পর্কে এই অল্প বয়সে ধারণা হয়েছিলো। সেই সময়ে প্রতিটি বাড়িতে দু’একটি হলেও ফুলের গাছ থাকতো। হিন্দু বাড়ি হলে জবা, টগর ইত্যাদি বারোমাসি ফুলের গাছ লাগানো থাকত। জমির অভাব ছিল না তাই বাগান করার অসুবিধা ছিল না। এখন সবার বাড়ির সামনে ফুল বাগান করার মতো আঙিনা নেই। তবে ঘরের পাশে ফুল গাছ লাগানোর সুযোগ আছে। তখনকার দিনে গ্রামে ফুলের টব কিনতে পাওয়া যেত না। জেলা শহরেও খুব একটা প্রচলন ছিলনা। নার্সারি ছিলনা তাই ফুলের চারা কিনতে পাওয়া যেত না। নিজেদেরকে বীজ সংরক্ষণ করতে হতো। এখন জমির অভাব কিন্তু চারার অভাব নেই। মানুষের সামর্থ্য বেড়েছে, ফুলগাছ কেনার টাকার অভাব নেই। খালি টব, ফুল গাছসহ টব নার্সারিতে পাওয়া যায়।
স্কুল থেকে প্রতিটি শিশুকে বাসায় কোন না কোন গাছ লাগানোর কাজ দেওয়া যায়। কিন্তু তা না দিয়ে শিশুদেরকে বাড়ীর কাজ দিয়ে ভারাক্রান্ত করা হয়। শিশুদের জীবন নিরানন্দ, উদ্বিগ্ন করা হয়। বাগান করার মাধ্যমে শিশুদেের যে শেখানো যায় সে বিষয়টি হয়তোবা আমরা ভুলে গেছি।
স্কুলের মাঠ:
আমাদের স্কুলের মাঠের কোন সীমানা প্রাচীর ছিল না, এখনো নেই। মাঠে একধরনের ঘাস ছিল এখনও সেই ঘাস আছে। এই ঘাসের কারণে মানুষ মাঠে গরু বাধতো। আর এক ধরনের ঘাস জন্মাতো যাকে চোরকাঁটা বলে, স্থানীয়ভাবে তার নাম ভাটই। কাপড়ে এগুলো লেগে যায়, তাই কিছুদিন পরপর হেডস্যার আমাদেরকে ভাটই তোলার আদেশ দিতেন।আমরা মাঠের এক প্রান্তে থেকে লাইন দিয়ে বসে ভাটই তুলতে তুলতে অপর প্রান্তে পৌঁছাতাম। এগুলো তুলতে গিয়ে আমাদের হাতে খুব ব্যাথা লাগত। এখন আর শিক্ষকরা এই কাজ করান না। সে সময়ে আজকের মত পলিথিন, কাগজ মাঠে ছড়িয়ে থাকত না। তার বড় কারণ তখন এত packaging materials ছিলনা। এখনকার কথা ভিন্ন, পলিথিন আর packaging এর কাগজে মাঠ ভর্তি থাকে। তখন আমাদেরকে মাঠ পরিষ্কার করতে হতো। গরুর গোবর ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা। মাঠে গরু বাধা নিষেধ ছিল। কিন্তু কেউ তা মানতো না। তাই আমাদেরকে গোবর পরিষ্কার করতে হতো। এখন এসব কিছুই করানো হয় না। অভিভাবক এগুলো পছন্দ করেনা। ভাটিই তুলতে দিলে এখনকার দিনে শিক্ষকের জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হতে পারে। অনেকে বলবেন আমার শিশুকে স্কুলে কাজ শিখতে দেইনি। কিন্তু বাস্তব জীবনে কাজ করতে হয়। জীবনে এই কাজ করার অভ্যাস থাকলে আর কোনো অসুবিধা হয় না। লজ্জা বোধ হয় না, সংকোচ হয় না, কষ্ট কম হয়। তবে বিপদজনক, কষ্টকর, ঝুঁকিপূর্ণ, পীড়াদায়ক, কিংবা শিশুর জন্য কাম্য নয় এমন কাজ না করানো উচিত।
সীমানা প্রাচীর :
সেকালে স্কুলের মাঠে বাউন্ডারি ছিলনা। আজকাল অনেকে বাউন্ডারির জন্য আবেদন করেন। বাউন্ডারিতে টাকা খরচ না করে এই টাকা দিয়ে একটি শ্রেণীকক্ষ করলে অনেক বেশি ফল পাওয়া যায়। তা সত্বেও মেয়েদের স্কুলে, কিংবা নিরাপত্তার কারণে অন্যান্য স্কুলে বেষ্টনীর প্রয়োজন পড়ে। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময় green বাউন্ডারির একটি ধারণা দিয়েছি। এটি একটি উদ্ভাবনীমূলক কাজ। এখানে গাছ দিয়ে সীমানা করার কথা বলা হয়েছে। আমরা আমাদের দেশের বেশিরভাগ সীমানাপ্রাচীর ঠকানো যায়। একসময় সীমানা সীমানা উপরে কাচ দেওয়া হতো। এখনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার কাটা দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিছু দেওয়া হয় না সে কারণে সহজে টপকানো যায়। অপরপক্ষে, বেত গাছ, নাটা কাটা গাছ, বৈচি গাছ, শ্যকুল ইত্যাদি দিয়ে বেড়া দিলে কোন কিছু নিয়ে ঢুকতে পারবে না। এছাড়া লেবু, করমচা, ইত্যাদি গাছের বেড়া দিয়ে ফল পাওয়া সম্ভব একসাথে নিরাপত্তা বেষ্টনীর কাজ করবে। ইট কংক্রিটের boundary দিয়ে পরিবেশ সুন্দর কিম্বা নান্দনিক হয় না। green boundary দিয়ে পরিবেশ সুন্দর, নান্দনিক করার সাথে সাথে নিরাপত্তা উন্নত করা সম্ভব।
আমিযখন ব্রিটেনাআমিনে telford university তে ছিলাম। telford ইউনিভার্সিটির কাছেই স্রপসায়ারে ব্রিটেনের ধনীরা বসবাস করে। তারা তাদের বাড়িতে গাছ দিয়ে গ্রিন boundary দেয়।
শ্রেণিকক্ষ:
শিক্ষা সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য উপযুক্ত শ্রেণীকক্ষ হওয়া চাই। শ্রেণিকক্ষের স্থাপত্য এবং সাজসজ্জা শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। স্কুলের দেয়ালে সাজসজ্জা শেখা উৎসাহিত করতে পারে।
আমাদের স্কুলটি ইট আর কাদা দিয়ে গাঁথা ছিল। বর্ষাকাল আসতেই ফুটো চাল দিয়ে পানি পড়ে দেয়াল ভেঙে পড়ত। কখনই দেয়াল দেখিনি। আমি যখন ভর্তি হলাম চালের অবস্থাও সঙ্গিন। তাই স্কুল ঘর পরিত্যাগ করা হলো। ইস্কুলের সীমানার মধ্যেই তাল পাতা দিয়ে ইট বিছিয়ে স্কুল শুরু হল। প্রতিবছর আমরা সবাই মিলে তালপাতার ছাউনি দিতাম। যারা একটু বয়স্ক ছেলে তারা এ কাজ করত, আমরা সাহায্য করতাম। এদের মধ্যে অনেকেই খেজুর গাছে উঠায় পটু ছিল। তার বাবাদেরকে খেজুরের রস করার ব্যাপারে সাহায্য করত। আবুল ভাই তার মধ্যে অন্যতম। এছাড়া আরও অনেকে ছিল। স্কুলে কোনো দেয়াল বা বেড়া ছিলো না। দেয়াল সাজানোর তো প্রশ্নই ওঠে না। সম্ভবত আমাদের শিক্ষকদের মাথায় এটা কখনো আসেনি। এই কষ্টটা আমারও ছিল। এরপর এ বিষয়ে পড়াশোনা করেছি বিদেশে গিয়ে স্কুলের দেয়াল দেখে চমৎকৃত হয়েছি। যতবার পরিদর্শনে গেছি বক্তৃতা দিয়েছি সব জায়গায় বলেছি দেয়ালে learning material দিয়ে সাজাতে। কিন্তু কালচারের বাইরে যাওয়া সোজা না, প্রাকটিসের বাইরে যাওয়া আরো কঠিন। আমাদের দেশের স্কুলগুলোর আজকাল আর দেয়ালের অভাব নেই। দরজা জানালা আছে। তালা দেয়ার সুযোগ আছে। আমার স্কুলের সবই সদর, সবই খোলা।
আসবাবপত্র:
আসবাবপত্র বলতে প্রত্যোক শিক্ষকের জন্য একটি করে চেয়ার, কিছু কিছু বেঞ্চ ছিল তবে অপর্যাপ্ত। কোন আলমারি ছিলো না। তাই হাজিরা খাতা থেকে শুরু করে সকল খাতা-পত্র স্কুলের সভাপতি অর্থাৎ আমাদের বাড়ীতে রাখা হতো। আগেই বলেছি ক্লাসে বেশ বড় বড় ছেলে মেয়ে ছিল। মেয়েদের সংখ্যা অতি নগণ্য। দুষ্ট ছেলেরা চেয়ারের তক্তার সংযোগস্থলে বাবলার কাটা উল্টো করে দিয়ে রাখত। স্যার ব্যাথা পেলে তারা খুশি হত। কিন্তু আমি দেখেছি তারা লেখাপড়া বেশিদূর এগোতে পারেনি। একজন সেনাবাহিনীর সেপাই হয়েছিলেন। তাও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুবাদে। বাদবাকিরা সবাই হেলিকপ্টার (ভাড়ায় সাইকেল চালানো), ভ্যান গাড়ি কিংবা খেজুরের রস কাটার বিশেষজ্ঞ হয়েছেন।
ইস্কুলের নথিপত্র সংরক্ষণ:
আমাদের সময়কার তো দূরের কথা, এক দশক আগে গেলেও স্কুলের কোন রেকর্ড পত্র পাওয়া যাবে না। আমার আমলের কোন নথিপত্রে আমার স্কুলে সংরক্ষিত নেই। এখনকার যেসব শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন বা শিক্ষক কাজ করছেন এক দশক পরে তাদের কোনো রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই আমার সম্পর্কে সে জাতীয় কোনো তথ্যই স্মরণশক্তির বাইরে বলার উপায় নেই। আমাদেরকে এসব বিষয়গুলো ভেবে দেখা দরকার। বাংলাদেশের সাধারণভাবে বলা যায় institutional মেমোরি কিংবা রেকর্ড সংরক্ষণ মান অত্যন্ত নিম্ন। ক’বছর আগে কি ঘটেছিল তা না জান পারলে আগামী দিনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব না। সে কারণে আমাদের knowledge society গড়ার রাস্তাটা সুগম না। artificial intelligence নিয়ে কাজ করতে হলে অনেক বছরের ডাটা লাগে। আমাদের ডাটা সংরক্ষণের দুর্বল সংস্কৃতির জন্য artificial intelligence আমাদের অবদান রাখার সুযোগ খুবই কম। আরো সুনির্দিষ্টভাবে যদি শিক্ষাক্ষেত্রের কথা বলি তবে চিত্রটি আরো নেতিবাচক। আমাদের এই অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে না পারলে আমাদের অনেকের পিছনের কর্মকান্ড জানা সম্ভব নয়। আগামী প্রজন্মকে ও অতীতের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড দিয়ে সমৃদ্ধ করার সুযোগ থাকবে না।
চারুকারু কলা:
শিক্ষকরা নিয়মিত চারু কারু কলার ক্লাস নিতেন। হাতে-কলমে কাজ দিতেন, বাড়ি থেকে এগুলো তৈরি করে আনতে হতো। বেশিরভাগ মাটির কাজ, কোন কোন সময়ে কাগজের কাজ। তারা কেউই চারুকলায় লেখাপড়া করেননি, তাদের কোন চারুকারুকলা প্রশিক্ষণ ছিল কিনা জানিনা। তবে একথা বলতে পারি তারা খুবই আন্তরিক ছিলেন। তাদের এই বিষয়ের শিক্ষক নেই তাই কোনো অজুহাত খাড়া করে ক্লাস থেকে বিরত থাকেননি। আজও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চারুকলা বিষয় আছে শিক্ষক নেই। অদূর ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। যশোর, নড়াইল, রাজশাহী, বগুড়া ইত্যাদি জেলায় বেশ কয়েকটি চারুকলা বিদ্যালয় আছে তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করা গেলে কিছু শিক্ষক তৈরি করা সম্ভব হতো য়তো। ভালো মানের শিক্ষক তৈরি ছাড়া ভালো শিক্ষা দেয়া সম্ভব না। আমার এক বছরের মেয়াদে আমি নজর দিতে পারিনি। আমার ইচ্ছা ছিলো সরকারি করা।
ধর্ম শিক্ষা:
ধর্ম ক্লাসের সময় ব্যবহারিকভাবে ধর্ম পালন শেখানো হতো। শিক্ষক আধা কিলোমিটার দূরে সবাইকে খাজুরার বাওড়ের ঘাটে নিয়ে যেতেন। এই ঘাট মকবুল কাকাদের ঘাট নামে পরিচিত। পাশেই তাদের বাড়ী তিনি ২০১৪ সালে মারা গেছেন। এই ঘাটে বড় বড় তালের গাছ ফেলানো থাকতো। এর উপর বসে মানুষ হাত মুখ ধুতো। এর উপর সে অজু করতে হতো। শিক্ষক আমাদেরকে দেখিয়ে দিতেন কিভাবে ওজু করতে হয়। এরপর সবাইকে স্কুলে নিয়ে আসতেন। সেখানে সারিবদ্ধ ভাবে নামায পড়ানো শেখাতেন। সেকালে নামাজ শিক্ষা বই সহজলভ্য ছিল না। নামাজ পড়ানোর রোল প্লে করতেন। কিভাবে ইমামতি করতে হয় তাও শেখাতেন।
ছোটবেলায় থেকেই কোরআন শরীফ পড়া শিখতে হতো। উত্তরের ঘর থেকে ১০০ গজ দূরে খড়ের চালের বড়সড় বৈঠকখানা ছিল। ইমাম সাহেব এখানে থাকতেন। বৈঠকখানা ৫০ মিটার দূরে মসজিদ।
শবে বরাতের সবার বাড়িতে মিলাদ হত। পাড়ার এক প্রান্ত থেকে শুরু করে অপর প্রান্তে প্রতিটি বাড়িতে মেলাত পড়তে পড়তে রাত ভোর হয়ে যেত। মিলাদে রুটি গুড় নারকেল দেওয়া ক্ষীর দেয়া হতো। সরু পিঠা, ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে সেমাই দেয়া হতো। এখন আর শবেবরাতে প্রতিটা বাড়িতে মিলাদ হয়না। যৌথভাবে মিলাদ দেওয়ার কোন রেওয়াজ এখন আর নেই।
যে যার মতো কোরবানি দিতো। এখন সবাই এক জায়গায় কোরবানি দেয় এবং মানুষকে মাংস ভাগাভাগি করে দেয়। কোরবানির সময় খুব কম পরিবারের গরু কোরবানি দেওয়ার ক্ষমতা ছিল। তবে অনেকের ছাগল পোষার কারণে ছাগল কোরবানি দিতো।
সকাল দশটার দিকে ঈদের নামাজ শুরু হতো। কোরবানি করতে দুপুর হয়ে যেতো। এদিক থেকে অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন সকাল ৮টায় ঈদের নামাজ হয়। তারপর কোরবানি দেওয়া হয় এবং দুপুরের মধ্যেই কোরবানির মাংস বিতরণ শেষ হয়।
ঈদের খুব কম মানুষ নতুন পায়জামা পাঞ্জাবী কিনতে পারতো। বেশিরভাগ মানুষ লুঙ্গি পাঞ্জাবি পরে ঈদের মাঠে যেত। এখন প্রায় সবাই নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি টুপি স্যান্ডেল পরে ঈদের মাঠে যায়। ঈদের দিন বাড়িতে সেমাই রান্না করা হতো। এখনকার মতো রেডিমেড পাঞ্জাবী পাওয়া যেত না। রাজগঞ্জ হাটে গিয়ে পাঞ্জাবি সেলাই করাতে হতো।
পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কর্মকান্ড:
স্কুলের নিয়মিত নাটক হতো। রাষ্ট্রীয় বিশেষ বিশেষ দিনে নাটক মঞ্চস্থ করা হতো। এমনি একটি নাটকে আমি লিয়াকত আলি খানের ছেলের পাঠ করেছি। আমাকে সবাই রাস্তাঘাটে যেখানে পেত সেখানে লেখকদের ছেলে বলে ডাকত। রসিকতা কর্তব্যরত। তারপরও শিক্ষকরা নিয়মিত নাটক করাতেন। আবৃত্তি করাতেন। সম্ভবত স্কুলের জন্য এ বিষয়ে সরকার থেকে টাকাও বরাদ্দ করা হতো।
কালি কলম:
প্রথমে স্লেট ও স্লেট পেনসিল, এরপর কলম-কাগজ-কালি দিয়ে লেখা শুরু হয়। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে প্রাকৃতিক কলম বানানো হত। খেজুর গাছ কাটা দা দিয়ে সুন্দর কলম তৈরি করা হতো। সুচালো মাথাটা দা দিয়ে এমন ভাবে সামান্য চেরা হত যেন এটা কিউনিফর্মের মত হয়। সুচালো মাথাটা কালিতে চুবিয়ে কাগজের উপর লেখা হত। মোটা দাগ পড়ত তবে কলম উল্টো করে চিকন দাগ দেয়ার ব্যবস্থা করা যেত। এই কলম বেশ কয়েক মাস চালানো সম্ভব হতো। শুকিয়ে রাখতে পারলে দীর্ঘস্থায়ী হত। দোয়াত কালিসহ দোকান থেকে কেনা হত। তবে কয়লা গুঁড়ো করে সিম পাতার রস দিয়ে কালি তৈরি করা হতো। স্কুলে গেলেই নড়বড়ে বেঞ্চ থেকে দোয়াত পড়ে জামায়, হাতে মুখে কালি লাগতো। পরবর্তীকালে একধরনের দোয়া পাওয়া যেত যা পড়লেও কালি বের হতো না। ভিতর দিকে মুখটা একটু ঢুকানো থাকতো উল্টো করলে ভেতরে কালি বেঁধে থাকতো। বেশি পরিমাণ কালি ভরলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। এখন সে দোয়াতের প্রচলন নেই। পরবর্তীকালে fountain pen কিনতে পাওয়া যেত। যার মধ্যে কালি ভরে অনেকদিন, অনেকক্ষণ লেখা যেত। কালি ঢেলে ভরতে গিয়ে হাতে কালি লাগতো। পরবর্তীকালে ড্রপারসহ কলম পাওয়া যেত যার পিছন টিপ দিয়ে কালি ভরা যেতো এরমধ্যে pilot pen অনেক উল্লেখযোগ্য ছিল। এছাড়া আরো বেশ কয়েকটি কোম্পানির কলম ছিল। এখন বলপেন হয়েছে তাই জামা-কাপড় এ খাতে মুখে কালি লাগার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আলাদা কোন দোয়াত দরকার হয় না। শিষ কিনে পাল্টানো যায় কিম্বা একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া যায়। অবিশ্বাস্য রকমের সস্তা। এই নতুন টেকনোলজিতে লেখাপড়ার অনেক সহজ হয়েছে, সস্তা হয়েছে। তবে কেউ কেউ আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করে।
কর্ণফুলী পেপার মিলের সাদা কাগজ পাওয়া যেত। কিছু কিছু সস্তা কাগজে কালি চুষতে। বাঁশপাতা কাগজ পাওয়া যেত বেশ সস্তা। যখন বেশি লেখা দরকার হত, এসএসসি পরীক্ষার আগে প্রাকটিস করার দরকার হত সেই সময় এই ধরনের সস্তা কাগজ ব্যবহার করা হতো। সাশ্রয় হতো এবং অনেক বেশি লিখে দক্ষ হওয়া যেত। পরবর্তীকালে নিউজপ্রিন্টের কাগজে বলপেন দিয়ে লেখা হতো। সেটা অনেক পরের কথা। technology লেখাপড়াকে অনেক ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। সাম্প্রতিককালের information technology সাথে সংশ্লিষ্ট গ্যাজেটগুলোর কথা চিন্তা করলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। এগুলো ব্যবহার করে লেখা অনেক বেশি সহজ। অল্প সময়ে অনেক বেশি লেখা যায়। বারবার ব্যবহার করা যায়। সস্তা তো বটেই। হুবহু কপি করা যায়। সংরক্ষণ করা যায়। সংকলন করা যায়। বিভিন্নভাবে রূপান্তর করা যায়। সাম্প্রতিক কালে মৌখিক কথা থেকে মেশিনে লেখা হয় বা লেখা থেকে মৌখিক কথা তৈরি করা বা ক্লাউডে সংরক্ষণ করা এসবই লেখাপড়ার মানকে উন্নত এবং সার্বজনীন করছে।