কষ্টের দিনগুলো দীর্ঘায়িত মনে হয়। স্মৃতি হিসেবে সেই কষ্টের দিনগুলো গৌরবময় মনে হয়। ময়মনসিংহের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল। অবশ্যই হিসেবে আমাকে সরকারি কোয়ার্টার দেওয়া হয়নি তাই জেলা পরিষদের ডাকবাংলো একটি কক্ষে অবস্থান করতে হয়েছিল। দুটি কক্ষ চাওয়া হলেও তা দেয়া হয়নি। অবশ্য সেই সময়ে আবাসন সংকট ছিল। ময়মনসিংহ একটি পুরনো শহর এবং ঢাকার নিকটবর্তী হওয়ায় সব সময়ে পদস্থ কর্মকর্তা অতিথি আসতেন তাই তাদের অবস্থানের জন্য স্থানের প্রয়োজন ছিল। সার্কিট হাউজের কয়েকটি কক্ষ যথেষ্ট ছিল না। এছাড়া জনাব এরশাদের শ্বশুরবাড়ি হওয়ায় সার্কিট হাউসে অন্যদের ব্যবহার করার সুযোগ খুব কম ছিল। যদিও জেনারেল এরশাদের শ্বশুর পক্ষের লোকজন তাদের নিজেদের বাড়িতে উঠছেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকলে মোসাহেবদের কোন অভাব হয়না। আর মোসাহেবদের ঘোরে ফেরার জন্য সার্কিট হাউজ এর মত জায়গা দরকার। তখনকার দিনে বেতনের টাকায় সংসার চালানো খুব দুরুহ ছিল। জামিন দেওয়া না দেওয়ার টানাপোড়েনের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও আর্থিক কারণে আমি কখনোই সার্কিট হাউস থেকে রিক্সায় কোটে যায়নি। আমার অন্যান্য সহকর্মীরা সবসময় রিক্সায় চড়তেনা। উপজেলা পরিষদের একটি জিপ ছিল সেটি উপজেলা চেয়ারম্যান ব্যবহার করতেন। শুধু এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষার ডিউটি করার সময় এর ব্যবহার করতাম। এই জীপের ব্যবহার নিয়ে কাহিনী আছে সেটি অন্য একটি শিরোনামে পরে বলব। দ্বিতীয় মেয়ে ফারিয়া 16 ই আগস্ট ১৯৮৭ সালে জন্মগ্রহণ করেছে বড় মেয়ে ফ্রিডার জন্য দুধের দরকার। সে সময় এখনকার মতো দুধের কোম্পানি ছিল না কিংবা গরুর দুধ পাওয়া যেত না। তাই কৌটার দুধের উপরে নির্ভর করতে হতো। সেগুলো বাজারে উচ্চমূল্য এবং সব সময় পাওয়া যেত না। কালোবাজারে বিক্রি হতো। সরকার থেকে কম মূল্যে এগুলো দেওয়া হতো। যদিও প্রশাসনের কর্মকর্তারা এগুলো বিতরনের তদারকিতে থাকতেন তা সত্ত্বেও এগুলো পাওয়ার সহজ ছিল না। সেকালে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট সদর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ ছিল। তারপরেও আমার জন্য এগুলো সংগ্রহ করা বেশ দুরূহ ছিল। মেয়ের কিছুটা হলেও কষ্টে বড় হয়েছে। তখনকার দিনে আপেল আঙ্গুর বা কমলা লেবু পাওয়া যেত এবং বেশ আবেদন ছিল। ময়মনসিংহ সীমান্তবর্তী শহর সেই সময় সীমান্তের ওপার থেকে বিদেশি ফল পাচার হয়ে আসত। কিন্তু সেগুলো কেনার সামর্থ্য আমার ছিলনা। বিকল্প বিকল্প ইনোভেটিভ পথ খুঁজতে হয়েছিল। সে কারণে আমি তখনকার দিনের সস্তা টমেটো আপেল আঙ্গুরের বদলে মেয়েদের খাওয়াতাম। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ছাত্র হাওয়া পুষ্টিগুণ সম্পর্কে ধারণা ছিল। লাল টুকটুকে ওয়াক্স হার্ট বা ষাড়ের হৃদপিণ্ড টমেটো পাওয়া যেত। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর হলেও তখনো রাসায়নিক দিয়ে টমেটো পাকানোর প্রযুক্তি বা কেমিকাল কোনটাই চাষীদের জানা ছিল না। তবে এ কাজগুলো নীরবে করা হতো, অন্যান্য সহকর্মীরা জানতেন না। ১৯৮২ সালের ব্যাচের মোখলেছুর রহমান নামের একজন কর্মকর্তা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি বিএনপির আমলে ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ এবং আমি উল্টোদিকের হলেও আমার সাথে সব সময় এসব বিষয়গুলো উল্লেখ করে শ্রদ্ধার সাথে কথা বলেছেন। তিনি যে এসব বিষয় লক্ষ্য করেছেন তাও সেই সময়ে এসব বিষয়গুলো উল্লেখ করার জন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে আমি গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও তার জন্য কিছুই করতে পারিনি। তবে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ ছিল এবং থাকবে। উল্লেখ করেছি যে সংসার চালানো কষ্টকর ছিল। প্রতিদিনের খাবারের সাথে কম্প্রোমাইজ করতে হতো। বেশিরভাগ সময় আমরা কচুর লতি, মিষ্টি কুমড়ো আর ইলিশ মাছ খেতাম। তখনকার দিনে এখনকার মত গায়ে মোটা স্বাস্থ্যবান কচুর লতি পাওয়া যেত না। দেশীয় চিকন রোগা-পটকা কচুর লতি পাওয়া যেত অত্যন্ত সস্তা এবং খেতেও সুস্বাদু তবে কুটতে কিছুটা বেশী সময় লাগতো। ভাববার কোন কারণ নেই তখনকার দিনে ইলিশ মাছ খুবই সস্তা ছিল। আমরা আরো একটা জিনিস আবিষ্কার করেছিলাম সেটি হচ্ছে ইলিশ মাছ কেটে বিক্রি হতো। এবং অধিকাংশ ক্রেতা ইলিশ মাছের ডিম পছন্দ করতেন না। সেগুলো মাছের দোকানে আলাদাভাবে সস্তায় বিক্রি করা হতো। আমি সেগুলো কিনতাম আমার স্ত্রী সেগুলো পেঁয়াজ দিয়ে ভুনা করতেন। পেয়াজ অর্ধ সিদ্ধ থাকতো খাওয়ার সময় কিছুটা কচ কচ করত কিন্তু ডিমগুলো সিদ্ধ হয়ে যেত। এই খাবার আজও আমাদের জিভে পানি (লালা) আনে। এ বিষয়ে সে পারদর্শিতা অর্জন করেছিল। ময়মনসিংহর একজন হিন্দু মুন্সেফ ছিলেন তিনি আমাদের অবস্থা বুঝে ফেলেছিলেন এবং অত্যান্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন। তার বাড়িতে আমরা বেশ কয়েকবার দাওয়াত খেয়েছি। প্রথমবারের মতো সিলভার কার্প খেয়েছিলাম। তিনি আমাদের ডাকবাংলোর কক্ষে আসতেন। কখনো কোন তদবির করতেন না আজকে তার নাম স্মরণ করতে পারছি না। আমাদের কোন টেলিভিশন ছিল না। সৌখিনতার কোন প্রশ্নই আসেনা। খাওয়া-পরার কষ্ট থাকলেও কই মাছের মত কানকো আলগা করে, শিরদাঁড়ার কাটা খাড়া করে দিন গুজরান করতাম। নিজের কাজগুলো ক্রিটিক্যাল থিংকিং দিয়ে সুচারুভাবে করার চেষ্টা করেছি।
Share this post