শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা আমি এভাবে সংজ্ঞায়িত করি- “শিক্ষা জীবনের জন্য সাধারণ প্রস্তুতি;
প্রশিক্ষণ বিশেষ কাজের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি;
অভিজ্ঞতা শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ লব্ধ অর্জনের প্রয়োগ ফল”।
যারা আমার মত বিএসসি অনার্স এবং এমএসসি তবে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছেন কিংবা শিক্ষাজীবনে ভালো ফলাফল করেছেন। তাদের অনেককেই এমনভাব দেখাতে দেখেছি যে তাদের সারা জীবন আর কিছু প্রয়োজন নেই। শিক্ষাজীবনের অর্জন দিয়েই চলবে। আমরা অনেক সময় উপলব্ধি করি না জীবন অনেক দীর্ঘ। সময়ের সাথে পৃথিবীর সব কিছুই পরিবর্তিত হয়। তাই পরিবর্তনের সাথে আমাদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। টিকে থাকতে হয়। সেজন্য প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। সিঙ্গাপুরের মতো অনেক দেশেই। বছরে অন্তত ১০০ ঘন্টার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। যখন চাকরিতে ঢুকেছি তখন বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১২০ ডলার। আর্থিক দৈন্যতা ছাড়াও মানসিকতার সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রশিক্ষণের তেমন একটা ব্যবস্থা ছিল না। ব্যবস্থা থাকলেও প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য করতে পারত না। তাই আমাদের প্রশিক্ষণ অনেকটা ক্লাসরুম শিক্ষার মতোই ছিল। সিএসপি অফিসার অন্তত দুই বছরের প্রশিক্ষণ নিতেন। বাংলাদেশ হওয়ার পরেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু আমাদেরকে নতুন সৃষ্ট উপজেলায় এবং বিকেন্দ্রীকৃত বিচারব্যবস্থা চালু করার জন্য একসাথে নানা বয়সের অনেক অফিসার রেকর্ড করা হয়েছিল। তাই প্রশিক্ষণ কে সংক্ষিপ্ত করে তিন মাসের কোর্স করা হয়েছিল। এবং একসাথে অনেক শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করানো হয়েছিল। দুটি বিষয়ে প্রশিক্ষণের গুণগত মানের জন্য সহায়ক নয়। তারপরও তৎকালীন চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শামসুল হক, ব্যারিস্টার শফিকুর রহমান, ব্যারিস্টার, গাজী শামছুর রহমান প্রমুখের জন্য ক্লাসগুলো প্রাণবন্ত ছিল। প্রশিক্ষণ কত দীর্ঘ তার চেয়ে বড় কথা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে জানার এবং প্রয়োগের এবং প্রয়োগের পর পুনঃসংশোধন অর্থাৎ কভস লার্নিং সাইকেল ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা। রোগের পর যদি অবিরত সংশোধন ও উন্নয়নের ব্যবস্থা করলে শিক্ষায় স্প্রিংয়ের মতো উপরের দিকে যেতে থাকে। একই বিষয়ে যদি শুধু প্রয়োগ করা হয় কিন্তু ফলাফল থেকে সংশোধন উন্নয়নের চেষ্টা করা না হলে অভিজ্ঞতা একটি বৃত্তের মত হয় শিক্ষার কোন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা থাকে না। প্রশিক্ষণের আরেকটি বিষয় হচ্ছে নেটওয়ার্কিং। সে জন্য বিভিন্ন কার্ডের বা বিভিন্ন সার্ভিসের মানুষের একত্রে প্রশিক্ষণ হলে সেই প্রশিক্ষণ বেশি ফলপ্রসূ হয়। বিভিন্ন বিষয়ের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে চিন্তা করে। কোন একটা বিষয় সম্পর্কে আদ্যোপান্ত শেখা হয়ে যায়। একটি বাস্তব উদাহরণ উল্লেখ করি- আমি বৃটেনের একটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি। সেখানে আলোচনা হচ্ছিল সহকর্মীদের মধ্যে যদি কাজে অনাগ্রহ দেখা যায়, অনুপস্থিত থাকে তাহলে সেগুলো কিভাবে মোকাবেলা করা যায়। সেদিন আমার পেটটা একটু খারাপ ছিল। তাই কিছুক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ ক্লাসের বাইরে গিয়েছিলাম। ইতিমধ্যেই টিমওয়ার্ক শেষ হয়ে গেছে এবং প্রেজেন্টেশন এর সময়। আমি ছাড়া প্রায় সবই ইউরোপিয়ান কালচারের মানুষ। তবে একজন ভারতীয় ছিল। সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ওই কর্মীর বাড়িতে গিয়ে স্ত্রী অথবা পরিবারের সদস্যের কাছে জিজ্ঞাসা করবে তার কোন অসুবিধা আছে কিনা। এরপর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম আমাদের কালচারের জন্য এটি বিপদজনক। কারণ আমার সহকর্মী যদি কমবয়সী হয় এবং তার স্ত্রী যদি আরো কম বয়সী হয়। আমি তার বাড়িতে গিয়ে তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে যদি জিজ্ঞাসা করি “আপনাদের কোন অসুবিধা আছে কিনা” তাহলে সে তার স্বামীর কাছে আমার ভিন্ন মাতলব তুলে ধরবে। সেই পরিস্থিতিতে ওই অফিসের টেকা দায় হবে! আমাদের প্রশিক্ষক বললেন ‘খান’ তুমি শুধু সমস্যা সৃষ্টি করো। আমি আমাদের উপমহাদেশীয় কালচারের কথা তুলে ধরলাম তখন সবাই আমার সাথে একমত হল। বিভিন্ন সার্ভিসের কর্মীরা একসাথে প্রশিক্ষণ নিলে সেখানেও বাড়তি কিছু পাওয়া যায়। একটি হলো নেটওয়ার্কিং। সরকারি-বেসরকারি যে কোন কাজই হোক না কেন বিভিন্ন বিভাগ বা অফিসের সহায়তা লাগে। বিভিন্ন অফিসের ইন্টারফেসিং করার জন্য একসাথে বিভিন্ন অফিসের কর্মীদের প্রশিক্ষণ সহায়ক হয়। কিছুটা বিস্তারিত বলি- লেখাপড়ার শেষের দিকে আমাদের সবার লক্ষ্য থাকে একটি চাকরি তার সরকারি বা বেসরকারি যাই হোক না কেন। চাকরি পাওয়ার পরে সে তার কমিউনিটির কথা চিন্তা করে এবং অন্যদের চেয়ে বেশি সুযোগ সুবিধা সম্মান পেতে চাই কিংবা তুলনা করে। কমবেশি বাস্তবে যাই হোক তার পারসেপশন বা ধারণা এখানে সবচেয়ে বড় হিসেবে দেখা দেয়। অনেক সুযোগ সুবিধা বেশি পান কিন্তু তার ধারণা অন্য সার্ভিসের লোক বেশি সুযোগ সুবিধা পায়। আর সুযোগ সুবিধা বেশি পেলেও সম্মান বা স্ট্যাটাস এর কথা চিন্তা করে অন্যের সাথে তুলনা করে। সম্মান একটা কালচারাল বিষয় সামগ্রিক একটি গ্রুপ বাস সার্ভিসের কালচার দুই/এক বছরে গড়ে ওঠে না। করে উঠতে বহু বছর লাগে। কিন্তু আমরা তা মানতে চাই না আমরা অনেক সময় মনে করি সরকার ইচ্ছা করলে আমাদেরকে সম্মান দিতে পারে স্ট্যাটাস বাড়িয়ে দিতে পারে। এসব কারণে নানা ধরনের বৈরিতা সৃষ্টি হয়। একই সাথে প্রশিক্ষণ নিলে আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়। পরবর্তীকালে আন্ত বা ভিন্ন অফিসের কাজকর্মের জন্য সহজ হয়। আমি সিভিল অফিসার ট্রেনিং একাডেমি ডরমেটরির ৩০১ নম্বর রুম বরাদ্দ পেয়েছিলাম। ওই রুম আব্দুল আজিজ নামের একজন ব্যাচমেট বরাদ্দ পেয়েছিল। তিনি পরবর্তী ব্যাচ এ কূটনীতিক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে তার লন্ডনে পোস্টিং হলে এবং আমি বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব হিসেবে লন্ডন সফরের সময় প্যারিসে যেতে চাইলে একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল আমি তখন তা জানতে পারিনি তবে পরবর্তী কালে তারজন্য জেনেছি। সে ঘটনাটি পরবর্তীতে কোন এক সময় লেখা যাবে। জীবনের প্রথম প্রশিক্ষণ আমাদের জন্য বেশ উপভোগ্য হয়েছিল। অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছিল, আন্তরিকতা, ঘনিষ্টতা হয়েছিল।