এই অভাগিনী দেশে আমার জন্ম দিবসই কি, আর মৃত্যুদিবসই বা কি- শেখ মুজিবুর রহমান, ১৭ মার্চ, ১৯৭১ জন্মদিনে সাংবাদিকদের সাথে জন্মদিবস পালন প্রশ্নোত্তরে।
আমার নিকটতম বন্ধু সতীর্থ শ্যামল কান্তি ঘোষ তার জীবন থেকে নেয়া একটা গল্প বলেছিলেন। তার জন্ম তারিখ ১১ এপ্রিল ১৯৫৯ কিন্তু তার শিক্ষক তার মঙ্গলের জন্য বাড়িয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭ তারিখ করেছিলেন। বলেছিলেন তুই তো বেশি কিছু হতে পারবি না বড়জোর পুলিশের কনস্টেবল তাই এক বছর বয়স বাড়িয়ে দিলে এক বছর আগেই পুলিশের ঢুকতে পারবি। যাহোক, শিক্ষকের ভবিষ্যৎবাণী ছাড়িয়ে বাংলাদেশের একটি বড় মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েছিলেন।
মনে পড়ে গেল ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালীন জানুয়ারি মাস আসলে আমাদের শিক্ষক হাসতে হাসতে বললেন তোমাদের সেলিব্রেশন মাস জানুয়ারি, বেশিরভাগের জন্ম এই মাসে। সত্যিই সেই মাসে আমাদের ক্লাসের অনেকের জন্ম তারিখ ছিল। তবে আমরা সবাই বাংলাদেশী না, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের উন্নয়নশীল দেশের। একটু দেরিতে বুঝেছি শিক্ষক কি বোঝাতে চেয়েছেন।
তৈরি করা জন্ম তারিখ বাঙালি জাতির একটি বড় সমস্যা বললে অপূর্ণতা থেকে যায় বরং একটি বড় ট্র্যাজেডি। চীনে স্কুল পরিদর্শনের সময় লক্ষ্য করেছি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মা-বাবার দেয়া নামের সাথে স্কুলের দেয়া ইংরেজী নাম থাকে। কিন্তু কল্পিত জন্ম তারিখ দেয়ার কোন তথ্য জানি না।
অপরদিকে, আমাদের জন্ম থেকেই মিথ্যার সাথে বসবাস। জীবন মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে। জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে এক, দুই বছর বা তিন বছর বেশি চাকরি করা যায়; গাড়ি-বাড়ি বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা- এটুকুই সুবিধা। কিন্তু মনের ভিতরে অস্বস্তি থেকে যায়। আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভিআইপিদের ক্ষেত্রেও এই ধরনের ঘটনা দেখেছি।
ইউনিয়ন পরিষদে জন্ম রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৮৮৬ সাল থেকেই জন্ম মৃত্যু এবং বিবাহ নিবন্ধন আইন আছে কিন্তু এর সঠিক বাস্তবায়ন নেই। এ বিষয়ে কাউকে খুব একটা মনোযোগ দিতে দেখিনি। যে জাতি বিসমিল্লায় গলদ, শৈশব থেকেই মিথ্যার চর্চা করে সে জাতিকে সত্যের দিকে ধাবিত করা কঠিন ?
আইন অনুযায়ী জন্ম নিবন্ধন ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব। কিন্তু তারা এই কাজ রুটিন হিসাবে করতো না। যিনি জন্ম নিবন্ধন সনদ নিতে আসতেন তার তথ্য অনুযায়ী জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়া হতো। ফলে তথ্যের বিশুদ্ধতা থাকেনি।
পাকিস্তান আমল পর্যন্ত মানুষ বেশিদিন চাকরি করার জন্য কোর্টে এফিডেভিট করে বয়স কম করেছে। বাংলাদেশ হওয়ার পর এটি বন্ধ করে দেয়া হয়। সাধারণত এসএসসি সার্টিফিকেটে লেখা জন্মতারিখের এর উপর নির্ভর করে বয়স নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু যারা এসএসসি পাস করেনি তাদের কি হবে ? সকলের জন্য একটি সাধারন ফুলপ্রুফ পদ্ধতি থাকা উচিত।
এটুআই এর জাতীয় প্রকল্প পরিচালক থাকাকালীন বর্ণিত ঘটনাগুলো মাথায় রেখে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র যা এখন ডিজিটাল সেন্টারে জন্ম মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য সফটওয়্যার তৈরি করিয়েছিলাম। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তারই ভিত্তিতে সার্টিফিকেট দেওয়া চালু করা হলো। এরপর দেখা গেল স্কুলে ভর্তি, পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন, পাসপোর্ট তৈরি, ও বিদেশে ইমিগ্রেশনের সময় ইউনিয়ন পরিষদে আসেন এবং সার্টিফিকেট পাল্টে দেওয়ার চাপ প্রয়োগ করেন কিংবা অর্থ দিয়ে প্রলুব্ধ করেন। নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলায় যে কোন একটি ইউনিয়নের সেবক আমাকে জানিয়েছিলেন তার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে আগের দেওয়া সার্টিফিকেটের জন্মতারিখ পাল্টিয়ে ভিন্ন জন্ম তারিখে সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য। এই অবস্থা হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য চিন্তাভাবনা করা হয়েছে।
গত দু’বছর যাবৎ সারা দেশের জন্ম মৃত্যু তথ্য ডাটা সেন্টারের সার্ভারের রাখা হয়েছে। যদি কোন ভুল হয় কিংবা অন্য কোন ক্ষমতাবান কর্তৃপক্ষ জন্ম তারিখ সংশোধন করতে চান, কিংবা নাম সংশোধন করতে চান তার একটা স্বীকৃত পদ্ধতি থাকা উচিত। না থাকলে দুর্নীতি হবে, ক্ষমতা প্রয়োগ করে পরিবর্তন করবে। তবে জেলা প্রশাসক পরিবর্তনের আবেদন গ্রহণ করেন এবং তদন্ত করিয়ে নির্দেশনা দেন সেই নির্দেশনা অনুযায়ী সংশোধিত সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়।
কোন পদ্ধতি যত উন্নত মানের হোক না কেন কালোত্তীর্ণ করতে হলে ধারাবাহিক উন্নয়ন দরকার।
এক সময় যেটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক অন্য এক সময় সেটি অপ্রাসঙ্গিক, আউট অফ ডেট, আউট মুডেড হতে পারে।
ইউনিয়ন পরিষদের জন্ম নিবন্ধন রেজিস্টার, প্রাইমারি স্কুলের ডেটাবেজের সাথে ইন্টারফেসিং করলে প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে জন্মতারিখ রেকর্ড করতে পারবে; পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। পরিবর্তনের চেষ্টা করা হলে কিংবা পরিবর্তন করা হলে তার প্রমাণ থাকবে এবং প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
একইভাবে ইউনিয়ন পরিষদ এবং প্রাইমারি স্কুলের সাথে সেকেন্ডারী স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি ইন্টিগ্রেশন থাকলে কোনভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব না। পরিবর্তন করা হলে কোথাও-না-কোথাও ধরা পড়বে। এভাবে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষা বোর্ড কিংবা বিভিন্ন সংস্থার সাথে ইন্টারফেসিং করা সম্ভব।
এভাবে ৪/৫ বছর চলতে থাকলে এক পর্যায়ে এমন একটি কালচার তৈরি হবে যে কেউই কখনো জন্ম তারিখ পরিবর্তনের কথা চিন্তা করবে না। এবং জন্মের প্রথম থেকেই মিথ্যাশ্রয়ী হয়ে জীবনের সাফল্যগুলোকে কালিমাযুক্ত করবে না।