রংপুর আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরেশোরে চলছে রংপুর টাউন কমিটি সাম্প্রতিক গঠন করা হয়েছে এবং বিভিন্ন শাখা কমিটি পুনর্গঠন করা হচ্ছে এমন সময়।২০শে জানুয়ারি ১৯৫৩ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমান দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া এবং রংপুর ভ্রমণের অংশ হিসাবে এখানে আসেন।সকাল ৯ টা ১৫ মিনিটে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে শেখ মুজিবুর রহমান মতিউর রহমানকে নিয়ে গাইবান্ধা ডাকবাংলো থেকে রংপুর রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। দুপুর ১২ টায় রংপুর রেলওয়ে স্টেশনে উপস্থিত হলে শ‘খানেক জনতা কায়েদে আজম জিন্দাবাদ, আওয়ামী মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সোহরাওইয়ার্দী, শেখ মুজিব জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে দিতে রেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসে। মোজাহার উদ্দিন এবং মাসুদুল হক চৌধুরী তাদেরকে রেল স্টেশনে স্বাগত জানিয়েপুষ্পমাল্যশোভিত করেন। এরপর একটি কারে রংপুর ডাকবাংলোয় জনসভায় রওনা হন।
শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের কারণ ব্যাখ্যা করেন। একই সাথে মুসলিম লীগের দুঃশাসন ও পাট, শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য এবং উন্নয়ন সম্পর্কে সমালোচনা করেন। পাকিস্তানের দুই বছর পর স্বাধীনতা পাওয়া চীন কিভাবে উন্নতি করেছে তার বর্ণনা দেন। এছাড়াও পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট বাতিল, পাকিস্তান অবজারভার বাতিলের আদেশ প্রত্যাহার, জমিদারি উচ্ছেদ, বাংলাকে ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি এবং ইস্টবেঙ্গলের লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি আগাম নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়েবক্তব্য রাখেন।
এই সময়ে নীলফামারী, গাইবান্ধাসহ অন্যান্য স্থান ভ্রমণ করেন এবং একই ধরনের বক্তৃতা-বিবৃতি দেন।
এরপর ৬ এপ্রিল ১৯৫৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান মিঠাপুকুর উপজেলার রানিপুকুর যান, সেখানে সভায় সন্ধ্যা ৭ টা ৪৫ মি. থেকে ৮ টা ৪৫ মি. পর্যন্ত বক্তৃতা করেন। ওই সভায় ঘোড়াগাছার মাওলানা তোফাজ্জল হোসেন, ফুলচাকির হাবিবুর রহমান চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান এই সভায় প্রথম চীফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিনের এ জি হাসপাতাল বন্ধ, কোন প্রথা চালু, তামাক-পান-সুপারি ইত্যাদি পণ্যের ট্যাক্স আরোপ, ইস্পাহানি ও আমিন ব্রাদার্স এর স্বার্থে পাটের স্বার্থ জলাঞ্জলি, ছাত্রহত্যা, অপশাসন ইত্যাদি বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। পরদিন ৭ ই এপ্রিল কাউনিয়া উপজেলার সরাই গ্রামে সন্ধ্যা ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত সভায় বক্তব্য রাখেন। এই সভায় মৌলভী হাবিবুর রহমান চৌধুরী, ডাক্তার মোজাহার উদ্দিন আহমেদ, ডাক্তার আব্দুল হামিদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
পরদিন ৮ এপ্রিল শোয়া চারটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত মিঠাপুকুর উপজেলার ভেন্দাবারি ডাকবাংলোর সম্মুখে সভা অনুষ্ঠিত হয়। তোফায়েল হোসেন, মতিউর রহমান, মাজহার উদ্দিন প্রমুখ ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় ডাক্তার আব্দুল জব্বার সভাপতিত্ব করেন।
পরের বছর ১৯৫৪ সালের ১৬ এপ্রিল রংপুর আসেন সেখানে তিনি ঘোষণা দেন আওয়ামী মুসলিম লীগ কে আওয়ামী লীগ করে ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠন করা হবে। তিনি উল্লেখ করেন মুজাহির মুজাহির নয় পাকিস্তানের নাগরিক; একইভাবে, হিন্দুরা মাইনোরিটি নয় পাকিস্তানের নাগরিক।
এরপর ১৯৫৭ সালে শিল্প বাণিজ্য, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে দোসরা এপ্রিল রংপুর আসেন। প্রাদেশিক কৃষিমন্ত্রী খয়রাত হোসেন এর সভাপতিত্বে সভায় শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতি দমন বিভাগ গঠনের ঘোষণা দেন। তিনি এই সভায় কোয়ালিশন সরকার কর্তৃক জননিরাপত্তা আইন বাতিলের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। একই সাথে তিনি শিক্ষা কমিশন গঠনের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসের ৯ তারিখ দিনাজপুর হয়ে রংপুর আসলেন। সকালে সেনপাড়ার মাসুদুল হক চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে রাত্রি সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত সভা করলেন। বিকেলে ৫.০০ থেকে রাত ৮.৩০ অব্দি পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে সভা করেন। এই সভায় পীরগঞ্জের মতিউর রহমান সভাপতিত্ব করেন। এই সভায় প্রায় ছয় হাজার জনতা অংশগ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি তাজউদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, পীরগঞ্জের মতিউর রহমান, মাসুদুল হক চৌধুরী, মোঃ সিদ্দিক হোসেন সেক্রেটারি রংপুর সাব-ডিভিশনাল আওয়ামী লীগ, রংপুর শালবন এলাকায় মুজিবুর রহমান, গাইবান্ধার লুৎফর রহমান, রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি নুরুল হক বক্তব্য রাখেন। পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধু এখান থেকে সদলবলে দিনাজপুর চলে যান এবং দিনাজপুরের ঘোড়াশহীদ ময়দানের ভাষণ দেন। সভায় তাজউদ্দিন আহমেদ কর্তৃক পায়োনিয়ার প্রেস থেকে প্রকাশিত ৬ দফার ব্যাখ্যা সম্বলিত বুকলেট ‘আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা কর্মসূচি‘ বিতরণ করা হয়।
চৌঠা এপ্রিল ১৯৬৬ সাল, মতিউর রহমান সাবেক সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সেক্রেটারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর নর্থ বেঙ্গল আয়রন এন্ড ষ্টীল ইন্ডাস্ট্রিস তেজগাঁও ঢাকা আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হন।
১৯৬৭ সালে লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের পর দেশে ফেরার পর একই বছর ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাথে ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়ার বিয়ে হয়। বাবা আব্দুল কাদের মিয়া এবং মাতা ময়েজুন্নেসার তিন কন্যা ও চার পুত্রের মধ্যে তিনি সর্ব কনিষ্ঠ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়ার সময় থেকেই ধীরে ধীরে রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট হতে শুরু করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের নির্বাচনে ছাত্রলীগ থেকে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। মতিউর রহমান এই বিয়েতে ঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সেই থেকে রংপুর বঙ্গবন্ধুর বিয়াই বাড়ি। ১৯৬৬ সালের ৮ ই মে থেকে ১৯৬৯ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটানা কারাগারে ছিলেন। এরপর বঙ্গবন্ধু বেশ কয়েকবার রংপুর গেছেন তবে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার বিভোর স্বপ্নের রাজনৈতিক ব্যস্ততায় আর স্বাধীনতার পর দেশের পুনর্গঠনের কাজে আত্মীয়তার আতিথেয়তা আড়াল পড়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র এবং দৌহিত্রী সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুল রংপুরের সন্তান তাই রংপুরের বঙ্গবন্ধু , বঙ্গবন্ধুর রংপুর।
এন আই খান
কিউরেটর
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর