সাইপ্রাসের প্রাচীন নাম এলাশিয়া Alasya, এখানে প্রচুর পরিমাণ তামা পাওয়া যেত ল্যাটিনে তামা Cuprium থেকে সাইপ্রাস শব্দটির উৎপত্তি। সাইপ্রাস ভূমধ্যসাগরের ছোট্ট একটি দ্বীপ তুরস্ক এবং সিরিয়া’র কাছাকাছি। যুদ্ধ ও যৌনতার দেবতা আফ্রিদিতি এখান থেকে গ্রিসে রপ্তানি হয়েছে। এলাশিয়ার উত্তরে প্রাচীন আমলে Hittaite হিটাইট পরাশক্তির উত্থান হয়েছিল; দক্ষিনে প্রাচীন মিশর (কেমেট বা কালো মাটির দেশ) Kamet; পূর্বে মিতানী, এসিরিয়া, পারস্য পরাশক্তি হিসেবে সময়ের সময় আবির্ভূত হয়েছে। প্রাচীন আমলে সাইপ্রাসের তামার খনি, উচ্চমানের ব্রঞ্জের অস্ত্র, গৃহজ্জা সামগ্রী, মাটির পাত্র ও এসবের কারিগর সাইপ্রাস পরা শক্তির কাছে লোভনীয় করে তুলেছিল। তাই কৌশলগত কারণে প্রাচীন সাইপ্রাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একাধিক দ্বীপ রাষ্ট্রের সমাহার।
চারিদিকে ভূমধ্যসাগরের জলরাশি বেষ্টিত হলেও নিরাপদ ছিল না। সেই প্রাচীন আমলে নৌপথে যাতায়াত বা সামরিক অভিযান অসম্ভব ছিল না। যদিও তখনকার দিনে এখনকার মত জাহাজ তো দূরের কথা কাঠের জাহাজও তৈরির কৌশল আলাদা ছিল। লোহা দুর্মূল্য হওয়ায় ধারালো অস্ত্র কিংবা করাত ছিল না যা দিয়ে তক্তা তৈরি করে পেরেক মেরে জাহাজ তৈরি করা হবে। বরং ব্রাঞ্চের কুঠারে কাঠ কেটে কাঠের খিল দিয়ে তক্তা জোড়া দিয়ে জাহাজ তৈরি করা হতো। মোম কিংবা বিটুমিন দিয়ে দুই তক্তার মাঝে ছিদ্র বন্ধ করে পানি ঢোকা রোধ করা হতো।
তাই সাইপ্রাস পার্শ্ববর্তী পরাশক্তির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলত। সে কারণে দক্ষ কূটনীতির আশ্রয় নিতে হতো। মিশরের শক্তিশালী যুদ্ধ নৌবহর ছিল, সাইপ্রাস এর সাথেও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। ব্রোঞ্জের যুদ্ধাস্ত্রসহ অন্যান্য সরঞ্জাম তৈরির জন্য তামা ও টিনের প্রয়োজন হতো। তাই মিশরীয় শাসকরাও সাইপ্রাসের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করত। কোন সময় মিশর ক্ষিপ্ত হোক তা সাইপ্রাস চাইতো না। ফেরাউনরা কখনো সাইপ্রাস দখলের চেষ্টা করেনি। এলাশিয়ার রাজার কাছে ফেরাউনের লেখা খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকের লেখা চিঠিতে ভাই বলে সম্মানের সাথে সম্বোধন করা থেকে এই সম্পর্কের কথা বোঝা যায়।
পরাশক্তিরা বর্তমান কালের মতই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। সাইপ্রাস দ্বিতীয় ক্যাম্বাইসিস আমলে পারস্য সাম্রাজ্যের আক্রমণে সাইপ্রাস পারাভূত হয় কিন্তু স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করার সুযোগ দিয়েছিল। দারিউস সেই ক্ষমতা কিছুটা খর্ব করে। এলাসিয়ার আদি মানুষ সম্ভবত সিরিয়ান এরপর এখানে ফইনিসিয়ান বা বর্তমান লেবাননের মানুষ ব্যবসা সূত্রে এসে বসবাস শুরু করে। এরপর গ্রীক জলদস্যরা এসে এখানকার মানুষকে বিপর্যস্ত করে বসত স্থাপন করে পরবর্তীকালে তারা রাজ্য শাসন শুরু করে। মুল আদিবাসীরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। এরপর আসে রোমানরা।
বাংলাদেশের সাথে প্রাচীন সাইপ্রাসের কূটনীতির মিল আছে। যে যাই বলি প্রাচীন বাংলাদেশীরা ভারতীয়। তাই ভারতীয়রা মনে করতেই পারে যে বাংলাদেশের রা ভারতের সাথে সম্পর্কিত। ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দুধর্মীদের মনে এই চিন্তা উদয় হয় স্বাভাবিক। ভারতের উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের নিয়ে অশালীন ইউটিউব কনটেন্ট বা বক্তব্য দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে। বাংলাদেশিরা নিজেরা যখন বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সাথে ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে জড়িয়ে অশালীন মন্তব্য বা কনটেন্ট তৈরি করে তখন তা রবীন্দ্রনাথের-‘নিজেকে করিতে গৌরব দান নিজেরই কেবলই করি অপমান’ বই আর কিছুই নয়।
এলশিয়া যেমন তামা, মাটির পাত্র, কিংবা ব্রোঞ্জের শিল্প পণ্য দিয়ে পরাশক্তিকে সন্তুষ্ট রাখতে পেরেছে। বাংলাদেশ তেমনি তাদের পোশক দিয়ে পরাশক্তি গুলোকে সন্তুষ্ট রাখতে পারে। কিছুদিন আগে আমরা জেনেছি। Trump বাংলাদেশের পোশাক পরেছেন আমরা যদি পৃথিবীর সকল দেশের সরকার প্রধানের জন্য এক সেট পোশাক গিফট করতে পারতাম তাহলে কেমন হতো ? আমাদের পোশাক পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্প ? কিন্তু আমরা কোন ব্র্যান্ড সৃষ্টি করতে পারিনি। সরকার প্রধানদেরকে গিফট করে তার একটা নাম দিলে সেটি ব্র্যান্ড নেম হয়ে যেত ? তারপর সেই নামে সারা পৃথিবীতে পোশাকের প্রচলন করা সম্ভব ছিল। আমাদের রাজশাহী আম আমি মনে করি বিশ্ব বিখ্যাত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে কাজ করার সুবাদে বিশ্বের সেরা আম খাওয়ার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে আমাদের ‘রানিপছন্দ’ আম পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আমের সর্বশ্রেষ্ঠ। আমরা কেন এগুলোকে ব্র্যান্ডিং করতে পারবো না। অনেক আম আছে যা পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ। আমি অনেক দেশের আনারস খেয়েছি সিলেটের জলডুগে আনারস আর পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি রানারসের পৃথিবীতে জুড়ি নেই। আমাদের পানি অফুরন্ত দেশের বাইরে থেকে ৯৭ ভাগ পানি আসে কিন্তু আমরা তা কাজে লাগাতে পারিনা। বর্ষার পানি মালয়েশিয়া থেকে এনে সিঙ্গাপুর সেই পানি শোধন করে কাজে লাগায়। আমাদের সাড়ি নদীর স্ফটিকের মত পানি কেন আমরা বোতলজাত করে রপ্তানি করতে পারবোনা ? কেন সেটা বিশ্বের ব্রান্ড হবে না ? ফ্রান্স সারা বিশ্বে পানি রপ্তানি করে ? এখনো সুযোগ আছে, যেভাবে দেশে দেশে বাধ তৈরি হচ্ছে আগামীতে এই সুযোগ হয়তো আর থাকবে না। এই পানি আমাদের প্রয়োজনীয় সেই যুক্তি দেখে অন্যদেরকেও আমাদের স্বার্থ বিরোধী কোন কাজ থেকে বিরত রাখতে পারব না। কোন কূটনীতি কাজ করবে না। “সময়ের এক ফোড়, অসময়ের দশ ফোড়”।
বাংলাদেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ নিকটতম প্রতিবেশী ভারত এবং চীন আমাদের কাছে পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অপরপরের শক্তি এমেরিকা দূরে হলেও তাদের একটা বড় প্রভাব আমাদের দেশে আছে। তাই আমাদেরকে সবাইকে কিভাবে সন্তুষ্ট রাখা যায় সেই কূটনীতির আশ্রয় নিতে পারা কুটনৈতিক দক্ষতা। এদের কারো সাথে গোলযোগ এমনকি মন কষাকষি আমাদের জন্য মঙ্গলজনক নয়। যা সবচেয়ে বিপদজনক তা হচ্ছে এক দেশের জনগণ কর্তৃক অন্য দেশের জনগণকে রাগান্বিত করা বা ক্ষিপ্ত করা। সে প্রবণতায় সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে যা দীর্ঘ মেয়াদে দুই দেশের জনসাধারণের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে পারে।
আমেরিকা ব্রিটিশ কলোনি ছিল তাদের মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে কিন্তু তাদের জনসাধারণের মধ্যে হৃদ্যতা থাকায় সকল তিক্ততা ভুলে গিয়ে বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। নামটা যে করিনি তা না, চীন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতা করেছেন কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তারাই আমার মনে হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটতম ব্যবসায়িক বন্ধুদের পরিণত হয়েছে। ভারত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ দিয়ে সাহায্য করেছে। তাদের সাথে আমাদের সীমান্ত বলা যায় চারদিকে। একদিকে বিশাল জলরাশি কিন্তু তার দুই পাশেই ভারতের উপস্থিতি একদিকে আন্দামান অপরদিকে ভারতের মূল ভূখণ্ড। এসবই আমাদের জন্য সুসম্পর্ক রাখার তাগিদ দেয়। কিন্তু সামান্য কাদা ছোড়াছুড়ি বা অসতর্কতা ভবিষ্যতের জন্য দীর্ঘমেয়াদে বিপদ ডেকে আনতে পারে।
অপরদিকে, চীনের সাথে বৈরিতা অর্থনীতি বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ভারত এবং চীন পরস্পর বৈরিতা পূর্ণ দেশ ১৯৬২ সালে যুদ্ধ করেছে, এরপরও ১৯৬৭ সালে খন্ড যুদ্ধ হয়েছে। আমেরিকা আমাদের দেশ থেকে বহু দূরে হলেও তার ব্যাপক প্রভাব আছে নানাভাবে বাংলাদেশে যেকোনো সময় বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সকল সময় আমেরিকা মতে সায় দিতে দেখা গেছে। আমাদের কাছেও দূরের পরাশক্তিকে উত্তেজিত করা ভয়ংকর আবার কোন একটি দেশের সাথে অসতর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়া বিপদজনক। কূটনীতিতে যদিও বলা হয় স্থায়ী বন্ধু বা স্থায়ী শত্রু কেউ না। স্থায়ী হলো স্বার্থ। কিন্তু আমাদের বিশেষ অবস্থান প্রতিবেশীর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া।
সাইপ্রাস যখন তাদের এই কূটনীতি থেকে সরে এসেছে তখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গ্রিক ও তুর্কি সাইপ্রিয়সের মতো বিভক্তি হয়েছে। বিভাজন মুহূর্তে করা সম্ভব একত্রীকরণে যুগ যুগ চলে যায়।








