“কাজ করলে শেখা যায়,
পরবর্তীতে ফল দেয়”
নতুন একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর সোজা কথা না। সরকারি টাকা আস্তে আস্তে সেপ্টেম্বর মাস হয়ে যায়। সে পর্যন্ত অপেক্ষা না করে মহাপরিচালক এ জেড এম শামসুল আলম নিজের টাকা দিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন। আমিও তার সাথে মন প্রাণ দিয়ে লেগে গেলাম। প্রশিক্ষণ কোর্স ডিজাইন করা শুরু করলাম। ব্রোশার তৈরি করলাম। প্রশিক্ষণার্থীদের থাকার জন্য যা যা দরকার তা কেনাকাটা করলাম। রান্নার জন্য যাবতীয় সরঞ্জাম কিনলাম। ফার্নিচার ছিল না। মহাপরিচালক মহোদয় সচিবালয় সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল। চিনিস সচিবালয়ের স্টোররুমে যত ভাঙাচোরা ফার্নিচার ছিল তা পাওয়ার জন্য আবেদন করলেন। যথারীতি সেগুলো পাওয়া গেল। একাডেমিতে এনে সেগুলো মেরামত করে ব্যবহার করতে শুরু করলাম। আরো অনেকে একা একা একাডেমিতে এসে যোগদান করলেন। সহকারি পরিচালক হলেও মহা পরিচালক মহোদয় আমার পরিশ্রমের জন্য পছন্দ করতেন। ক্লাস নেওয়া শুরু করলাম। প্রশিক্ষণার্থীদের শেষ দিন পরীক্ষা হওয়ার সাথে সাথে সবাই মিলে খাতা মূল্যায়ন করে, ফলাফল ঘোষণা করে সার্টিফিকেট দেয়া হতো। কোন কিছু পেন্ডিং রাখা হতো না। কিছু জনবল মাস্টাররোলে রিক্রুট করা হয়েছিল। সেই সময়ে বেশি সময় পাওয়ার জন্য অবিবাহিতদের রিক্রুট করা হয়েছিল। এমন অসংখ্য তারিখ গেছে যেদিন সারারাত তাদের কাজ করতে হয়েছে। আমাকেও সেই সাথে তাদের গাইড করতে হয়েছে। অনুপ্রেরণা দিতে হয়েছে। আমি ঘুমিয়ে থাকলে তারা কখনোই মানসম্পন্ন কাজ করতো না। পরবর্তীকালে মোগল সম্রাট বাবরের তুষারপাতের মধ্যে কাবুল থেকে দিল্লির পথের দুর্গম যাত্রার নেতৃত্ব তারই আত্মজীবনী পড়ে অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে নিয়েছি। বিসিএস প্রশাসন একাডেমি আমার জীবনের লক্ষ্য তৈরিতে গভীর ছাপ রেখেছে। জনাব শামসুল আলম এর সাথে চাকরি করারসুবাদে বাদবাকি জীবনে ইন্টেগ্রিটি বজায় রাখার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। তার মতো ত্যাগী কর্মকর্তা আমার জীবনে আমি কখনো দেখিনি। একইভাবে তার মত বঞ্চিত কর্মকর্তা আমি খুজে পাইনা। বিসিএস প্রশাসন একাডেমি তে এসে পড়াশোনা করার ব্যাপক সুযোগ পেয়েছি। বাংলাদেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মাইনর এক্ট পড়ে প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য হ্যান্ডআউট তৈরি করেছি। এবং ও এইচপি স্লাইড তৈরি করেছি। তখনকার দিনে এখনকার মতো পাওয়ারপয়েন্ট ছিলনা। ট্রান্সপারেন্সি স্লাইডিং হাতে লিখতে হত। ক্লাস নেওয়ার সময় ওভারহেড প্রজেক্টর এর সেগুলো দেখাতাম। হাজারেরও ঊর্ধ্বে ট্রান্সপারেন্ট ছিল। যক্ষের ধনের মত সেগুলো রেখে দিয়েছিলাম। বাসা বদল করতে করতে এক সময় সেগুলো ফেলে দিতে হয়েছে। আইনের ডিগ্রী না থাকলেও। দুটি উপজেলাতে সা ড়ে পাঁচ বছরের উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করার সময় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ডায়েরিতে লিখে রেখেছি। সেগুলো এখন কাজে লাগাতে শুরু করলাম। কোন প্রেক্ষিতে অর্ডার সেটা কি লিখতে হয় তার নমুনা অর্ডার শীট আদেশপত্র তৈরি করেছি। সেগুলো ক্লাস নেওয়ার সময় ওভারের প্রজেক্টরে দেখেছি। আমার প্রথম হাতে খড়ি ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড বাড়ি কার্যবিধির ক্লাস নেওয়া দিয়ে। এই বিষয়টি মূলত গাজী শামছুর রহমান পড়াতেন। উনি অসাধারণ পড়াতেন এবং একাই এই বিষয়টি কভার করতেন। প্রাক্টিক্যাল বিষয়গুলো যেটা শামসুল হক সাহেব ক্লাস নিতেন। চাহিদার তুলনায় এনাদের সময় কম ছিল। যেটা শামসুল হক তখন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট। তাই বিকল্প খোঁজা শুরু হল, আমি নিজেই বিকল্প হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। ঊর্ধ্বতনরা কিছুতেই মেনে নিতে চাইতেন না। জুনিয়ার তাই সে কীভাবে এসব ক্লাস নেবে। যাহোক ডিজি মহোদয় অনুমতি দিলেন এবং ক্লাস নেয়া শুরু করলাম। সেই সাথে অন্যরাও ক্লাস নিতেন তাদের অনেকের যুগ্ম সচিব ছিলেন। সমস্যা দেখা দিল যখন ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের মধ্যে পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা বা যুগ্ম-সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন আমার চেয়ে কম নম্বর পাওয়া শুরু করলেন। কিছু নতুন কর্মকর্তার পদায়ন হল, সবাই মিলে শেষ পর্যন্ত আমাকে ফৌজদারী কার্যবিধির ক্লাস বন্ধ করে দিলেন। তখন একজন ব্যারিস্টার দণ্ডবিধির ক্লাস নিতেন। দন্ডবিধি ক্লাসে কেউই তেমন একটা এনজয় করতেন না। আমাকে দেওয়া হল দণ্ডবিধির ক্লাস নিতে। যথারীতি হেবজো করে ফেললাম। স্লাইড প্রস্তুত করলাম। আমার পুরোনো ডায়েরি থেকে বাস্তব উদাহরণ দিয়ে ক্লাস নেয়া শুরু করলাম। দন্ডবিধির সাথে সিআরপিসি এবং সাক্ষ্য আইন এবং স্থানবিশেষে মাইন্ড রিলেট করে ক্লাস নেয়া শুরু করলাম। দাড়ি কার্যবিধির মত প্রশিক্ষণার্থীদের মূল্যায়নে এখানেও প্রথম বা দ্বিতীয় হয়েছি। সাক্ষ্য আইনের প্রশিক্ষকের দিকপাল ছিলেন ব্যারিস্টার শফিকুর রহমান। এই বিষয়টা খুবই কঠিন মনে করা হতো। আমরা কোন বিকল্প খুঁজে পাইনি। মাঝেমধ্যে অসুস্থ থাকতেন এবং কোর্টে ও ব্যস্ত থাকতেন। অনেককে দিয়ে আমরা টেস্ট করিয়েছি কিন্তু প্রশিক্ষণার্থীরা কাউকেই তেমন একটা পছন্দ করতেন না। এক পর্যায়ে আমাকে দন্ডবিধি থেকে সরিয়ে সাক্ষ্য আইন দেওয়া হলো। বিষয়টি আমার মনে পড়তে ছিল না। চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করলাম। মাঝেমধ্যে ক্লাস নেয়া শুরু করলাম। এখানেও প্রশিক্ষণার্থীদের মূল্যায়নে আমার অবস্থান শফিকুর রহমান এর পরেই। এভাবেই সারাজীবন বাধা-বিপত্তির মধ্যে কাটিয়েছি। অনেকে অনেক বিষয় থেকে সরিয়ে দিতে বা বঞ্চিত করতে চেয়েছে। কিন্তু কখনো হতাশ হয়নি, হাল ছেড়ে দেইনি। কিংবা কিছু পাওয়ার জন্য তদবির করিনি।