অন্য শিশুদের মতো মায়ের কাছে আমার হাতে খড়ি। পিতৃহারা হওয়ায় আমার মা প্রাইমারির গন্ডির বাইরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। সেকালে ছেলেদের কদর একটু বেশি ছিলো, তারপর আমি বাড়ির বড় ছেলে। তবে আমি দেখতে-শুনতে সুন্দর না হাওয়ায় এবং রোগা-পটকা হাওয়ায় বড় বোনের চেয়ে আমার গুরুত্বটা কিছু কম ছিল। মা’কে বাড়িতে বহুলোকের রান্নাবাড়া করতে হতো। বিশেষত চাষবাসের মৌসুমে বহু জন (কিষাণ) মাঠে কাজ করত। তাদের খাওয়ার জন্য মা’কে রান্না ব্যবস্থা করতে হতো।রান্নার ফাঁকে ফাঁকে মা আমাকে অক্ষরজ্ঞান দিতেন।কোন লেখা কাগজ পেলে সালাম করতে এবং চালে গুজে রাখতে বলতেন। যেন কেউ পায়ে না মাড়ায়। ছাপা কাগজ হলে তার কদর একটু বেশি। আরবি লেখা কাগজ হলে তো কথাই নেই। এটা শুধু আমার মায়ের জন্য না, তখনকার দিনে আমাদের মত বাংলাদেশের সকল পরিবারের জন্য প্রযোজ্য ছিল। ছাপা কাগজের যত্রতত্র ছড়াছড়ির জন্য সে মূল্যবোধ আজকাল আর নেই। মা’কে দেখেছি বাংলায় কিছু লেখা পেলে পড়ার চেষ্টা করে দক্ষতা বজায় রাখতে।
গতানুগতিক অক্ষর জ্ঞানের বই, সংখ্যা শেখার জন্য ধারাপাত, যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ শেখার জন্য নামতার বইয়ের মধ্যে লেখাপড়া সীমাবদ্ধ ছিল। লেখার জন্য স্লেট ও স্লেট পেনসিল ব্যবহার করা হতো। এর বাইরে প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো বই ছিল না। সেটা আমার এলাকার সব শিক্ষার্থীর জন্য প্রযোজ্য। এর বাইরে বইয়ের অভাব আমি অনুভব করেছি। তাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হওয়ার পর প্রাক-প্রাথমিকের বই তৈরীর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। যদিও আমার আগে অলরেডি একটি বই ছিল। যা অনেকটা সাদামাটা। আমি উদ্যোগ নিয়েও করতে পারেনি কারণ হার্ট অ্যাটাক। এবং পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে চলে যাওয়ার জন্য কাজ শেষ করতে পারিনি। তবে আমার পরবর্তী মহাপরিচালক জনাব শ্যামল কান্তি ঘোষ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজটি শেষ করেছেন। প্রাক প্রাথমিকের সুন্দর বই তৈরি করেছেন।
আজকাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক প্রকারভেদ হয়েছে। মফস্বল পর্যায়ে নার্সারি স্কুল হয়েছে। তবে কম বিত্তশালীদের শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক সেকশনে যায়। তখনকার দিনে এইসব সুযোগ ছিল না। ভেরাইটিস রকমের বইও ছিলনা। এখনকার মতো তখনকার দিনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফ্রি বই দেওয়া হতো না। এখন ধনী-দরিদ্রের বিভেদ ব্যাপক। গ্রাম পর্যায়ে অর্থনৈতিক পার্থক্য থাকলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনকার মতো এতো পার্থক্য ছিল না। যদি দুর্গম এলাকায় হতো তবে পার্থক্য আরো কম। তবে তার মানে এই না, যে গ্রামে মোড়ল মাতব্বর ছোট-বড় ছিলনা।
হাইস্কুলে যেতেই এই পার্থক্যটা দৃশ্যমান হত। খাতা পেন্সিল, বইয়ের ব্যাগ, স্কুলের পোশাক, জুতা ইত্যাদিতে এই পার্থক্য দৃশ্যমান হতো। সকলের খাতা-কলম কেনার সামর্থ ছিল না। প্রাথমিক স্কুলে কোন লাইব্রেরি ছিল না। তবে সরকার থেকে কিছু সহপাঠ্য দেয়া হতো। সেগুলো প্রধান শিক্ষকের কক্ষেই গড়াগড়ি দিতো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাসে পড়ার বাইরে বাড়িতে পড়াশোনা করতে হত না। যারা বড় বড় শহরের বাসিন্দা তাদের মধ্যে মুষ্টিমেয় হয়তোবা ভিন্ন ধরনের পরিবেশ পেয়েছিল। স্কুলে সবাই মিলে উচ্চস্বরে পড়তে হতো; সুর করে গানের মত করে পড়তে হতো। স্কুলের সংখ্যা কম হলেও তখনও শিক্ষকের স্বল্পতা ছিলো। তাই এক ক্লাসে শিক্ষক এসে সুর ধরিয়ে চলে যেতেন। আমরা সুর করে পড়তে থাকতাম। শিক্ষক অন্য ক্লাসে যেয়ে পড়ানো শুরু করতেন। আজও শিক্ষক সংকট আছে। দেশের উন্নতির সাথে সাথে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত কমতে থাকে। তাই আগামী দিনগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের হার বাড়লেও শিক্ষক স্বল্পতা থাকবে। মানুষের উন্নতির প্রচেষ্টা নিরন্তর, এটাই মানব জাতির ইতিহাস। তাইতো মানুষ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, আরামে আয়েশে, স্টাইলে, প্রযুক্তিতে, জীবনাচারে এত এগিয়েছে। এখনো এই প্রচেষ্টা ও অগ্রগতি অব্যাহত আছে এবং থাকবে, বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়।
আমাদের বাড়িতে মূল বসবাসের ঘর থেকে ১৫০ হাত দূরে মস্ত বড় একটা বৈঠকখানা ছিল। সেখানে একজন ইমাম থাকতেন। আমার বোন সাবিহা জন্মানোর পর থেকেই বৈঠকখানায় ইমামের কাছে দিনে-রাতে থাকতাম। তিনিই আমাকে আরবী পড়া শেখাতেন। প্রাইমারিতে থাকা অবস্থায় কোরআন শরীফ খতমও করেছিলাম। তবে আরবীতে কথা বলা শিখিনি, অর্থ বুঝিনি। স্কুলে পড়ার সময় অর্থ ও শানে নাজুল পড়ানো হয়েছিল। কিন্তু সূরা নাযিল হওয়ার সময়ের সামাজিক পরিবেশ, ইতিহাস ও প্রশাসন সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় অনুধাবন করতে পারিনি। বিষয়টি মনের মধ্যে শৈশব থেকেই রয়ে গিয়েছিল। আমরা দিনের ৯৮ ভাগ সময় কথা বলি এবং শুনি মাত্র ২ ভাগ সময় লিখি এবং পড়ি। বাস্তব জীবনে শোনা এবং বলার গুরুত্ব বেশি। সম্পর্ক তৈরীর জন্য, কেনাকাটার জন্য, দলে কাজ করার জন্য সুন্দর কথা বলার কোন বিকল্প নেই। মানুষের সাথে অন্য জীবের একটা বড় পার্থক্য মানুষের আর্টিকুলেটদ ল্যাঙ্গুয়েজ আছে অন্যের নেই। তারাই জীবনে সাফল্য অর্জন করে যারা কমিউনিকেশনে ভালো। তাই শিক্ষা সচিব হয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য আরবি বলা এবং শোনার জন্য ১০ নম্বর রেখে একটা সার্কুলার জারি করেছিল। আমি চলে আসার পর পরবর্তী যারা এসেছে তারা এ বিষয়ে কোনো মনোযোগই দেয়নি। আসলে experiential learning ভিন্নতর বিষয়। ভুক্তভোগী না হলে দরদ হয়না। অন্যদিকে কোন বিষয়ের অভিজ্ঞতা হলে স্থান-কাল-পাত্র চিন্তা না করে প্রয়োগ করলে হিতে বিপরীত হয়। তাই ক্রিটিক্যাল থিংকিং এবং লজিক্যাল থিংকিং এর বিষয়গুলো শিক্ষায় এসেছে।
আমি মনে করি সাঁতার দেয়া, সাইকেল চালানো, গাছে চড়া, গরু-ছাগল মুরগির সাথে দোস্তালি শিক্ষার অংশ হওয়া উচিত। গরু ছাগল মুরগি ইত্যাদির একটা behavior pattern আছে। যেমন বাচ্চা দিলে মুরগি ঠোকা দিয়ে রক্তারক্তি করে ফেলতে পারে। গরু গুতা বা লাথি দিতে পারে যা জীবনের জন্য হুমকি হতে পারে। কুকুর কামড় দিতে পারে এবং জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে। এসবই জীবনের জন্য শিক্ষা, জীবনব্যাপী শিক্ষা। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এই তালিকায় যোগ বিয়োগ হয়। মধ্য যুগে ঘোড়সওয়ার হওয়া এবং তরবারি পরিচালনা শেখানো হতো আজ তা শেখানো হয় না। এখন computer পরিচালনা, কেনাকাটা, যানবাহনে electronic payment শিখতে হচ্ছে। এই তালিকায় আজকের অজানা অনেক বিষয় যোগ হবে; আজকের অতীব প্রয়োজনীয় বিষয় আগামীতে হারিয়ে যাবে।
আমাদের বাড়ির সামনেই প্রায় এক কিলোমিটার চওড়া বাওড়, সারা বছর পানি থাকে। কবে সাঁতার শিখেছি তা মনে নেই তবে বছর তিনেক বয়স থেকেই বাওড়ে নামতে শুরু করেছি, পানির সাথে বেড়ে উঠেছি।
আমি যা বিশ্বাস করেছি, যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তাই বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি। তাই শিক্ষাসচিব হয়ে সাঁতারের জন্য circular issue করেছিলাম। অনেক স্কুলে পুকুর আছে সেগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখে সাঁতারের জন্য ব্যবহার করা যায়। যেসব স্কুলে পুকুর নেই তারা অন্য স্কুলের পুকুর ব্যবহার করতে পারে। নদী-খাল-বিলের পাড়ে school থাকলে তো কথাই নেই। তবে সতর্কতার জন্য সাঁতার শেখার সময় সার্বক্ষণিক শিক্ষক থাকতে হবে। লাইফ জ্যাকেট বা হাতের কাছের অন্য কোন লাগসই জিনিস ব্যবহার করতে হবে। আমরা সাঁতার জানলেও ছোটবেলায় বাওড় বাড়ি দেওয়ার সময় কলাগাছের টুকরো এবং ভাড় ব্যবহার করেছি।
অনেক ফেলনা জিনিস মাকে কাজে লাগাতে দেখেছি। রান্নাঘরের মেঝের সাথেই লাউ গাছ লাগানো হতো। ঘরের চাল বেড়ে যাওয়া লতায় অসংখ্য লাউ ঝুলে থাকত। কখনো কখনো উঠানের বানে লাউয়ের গাছ উঠিয়ে দেওয়া হতো। সেকালে প্রচুর মাছ খাওয়া হতো। মাছ কোটার পর অবশিষ্টাংশ, মাছ ধোয়া পানি লাউ গাছের গোড়ায় দেয়া হতো। এতে প্রচুর লাউ ধরতো। প্রতিটা বাড়ি দৈবাৎ কেউ লাউ কুমড়া কিনতো না। এই চিত্র এখন পরিবর্তন হয়েছে, বাড়িতে এসব সবজির গাছ লাগাতে চায় না। লাগানোর মত জায়গা নেই, আগ্রহ নেই কিংবা আয় বাড়ার কারণে এগুলো লাগানোতে তেমন একটা লাভ দেখেন না। এখন মাঠে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লাউ কুমড়ার চাষ হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি জমি ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মানুষ যে পরিবার ও পরিবেশ থেকে আসে তা সহজে ভুলতে পারে না। তবে শিক্ষার মাধ্যমে এই অর্জিত জ্ঞান বা অভ্যাস পরিবর্তন করা সম্ভব। শিক্ষা অধিদপ্তরে নতুন গাড়ি কেনা হলে পুরানো গাড়িগুলো ফেলে রাখা হতো। আমি একটি চিঠি দিয়ে পুরানো গাড়িগুলো টেকনিক্যাল স্কুলে ও কলেজে ড্রাইভিং শেখার জন্য দিয়েছি। তারা যেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে driver তৈরি করার সুযোগ পায়। ড্রাইভিং শেখার মাধ্যমে শিক্ষকরাও কিছু অতিরিক্ত আয় করতে পারে এবং সমাজকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ড্রাইভার দিতে পারে। এর ফলে আমাদের রাস্তায় চলার সংস্কৃতি পরিবর্তিত হবে, দুর্ঘটনার হার কমবে, যাতায়াতের শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। কিন্তু আমাদের অভ্যাস এর বাইরে যেতে চাই না, সেই কারণে সংস্কারকে সব সময় পীড়াদায়ক মনে করা হয়। সংস্কারে বিরোধিতাকারী বাড়ে, আক্রমনাত্মক ও হতে পারে তবে সংস্কার ছাড়া উন্নতি সম্ভব না। আমরা প্রশাসনে, রাজনীতিতে আরো বেশি বেশি সাহসী সংস্কারক চাই। দীর্ঘমেয়াদে সংস্কার বড় ফল দেয়। এটাকে এক ঋতুর ফসল এবং বহুবর্ষী ফল গাছ লাগানোর সাথে তুলনা করা যায়।
যে কেউ যে কোন ক্ষেত্রে সামান্য প্রচেষ্টায় innovation করে এরকম অসংখ্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে। একটি একটি করে ফুল দিয়ে মালা গাঁথতে হয়। এক ফুলের সাথে আরেক জাতের ফুলের মালা গেঁথে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা যায়। এজন্য বড় ক্ষমতার দরকার হয় না, যে যেখানে আছে, যে দায়িত্বে আছে সেখান থেকে করা সম্ভব। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ফসল একত্রিত করে বিশাল পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়। মানুষের চেয়ে কত ছোট মৌমাছিরা একটু একটু করে মধু সংগ্রহ করে মধুর ভান্ডার গড়ে তোলে। অনেক মৌচাকের মধু দিয়ে দেশে শত শত টন মধু উৎপাদিত হয়। মৌমাছির চেয়ে আমরা কত গুন বড়, প্রযুক্তিতে বলিয়ান।