সদ্য চাকরি পেয়েছি, শাহবাগে সিভিল অফিসার’স ট্রেনিং একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে মাদারীপুর পোস্টিং দেয়া হল। ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে মাদারীপুর যাই। একটা সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে বাসে মাদারীপুর স্ট্যান্ডে পৌঁছাই। একই বাসে মোহাম্মদ আলী পাশা নামের আর একজন ম্যাজিস্ট্রেট আমার মতই যোগদানের জন্য মাদারীপুর আসেন। আমার যাওয়ার বিষয়টি আগেই এসডিও সাহেবকে জানানো হয়েছিল। তখনোও মহকুমা আছে, কনক কান্তি বড়ুয়া তখন এসডিও বা মহাকুমা প্রশাসক। তার একটা লাল জিপ ছিল, সেই জিপটি বাসস্ট্যান্ডে পাঠিয়ে দিয়েছিল। মাদারীপুর এসডিও অফিসের নাজির সহজে মোহাম্মদ আলী পাশাকে চিনে নেয়। সে দেখতে বেশ লম্বা চওড়া এবং মোটাসোটা ছিল। আমি ছোটখাটো একেবারেই un impressive। নিক্সন মার্কেটের জামা আর কালো প্যান্ট পরা ছিলো। আমাকে অনুমান করতে পারছিল না, আমি গিয়ে তার কাছে পরিচয় দিলাম। সে আমাদের দু’জনকে পরম যত্নে জেলা পরিষদের ডাক বাংলোয় নিয়ে গেল। সেখানে আমরা অবস্থান করলাম, দু’জনের বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমাদের খাওয়া দাওয়ার জন্য কোন টাকা নেওয়া হলো না। অফিসে প্রথম হাজির হলাম। পরিচয় আলাপচারিতা হল। আমাদেরকে প্রথমে তেমন কোন কাজ দেয়া হলো না। কাশেম সাহেব নামের একজন বয়স্ক ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম শ্রেণি ছিলেন। তার সাথে কোর্টে আমাদেরকে বসতে বললেন। এছাড়া আমাদেরকে দু-একটি তদন্ত দেয়া হতো। চাকরিতে বেশ মজাই পাচ্ছিলাম। এসডিও সাহেব খুবই ভালো ব্যবহারের এবং আমাদেরকে যথেষ্ট ভালবাসতেন। সারাজীবন শিক্ষক আর বাপ-মায়ের খবরদারির মধ্যে ছিলাম। আমার মনে হলো সহকর্মীদের মাঝে আছি।
মাদারীপুরের প্রাকৃতিক পরিবেশটা খুবই সুন্দর ছিল। ডাক বাংলোর পাশেই একটা বড় দিঘী। দীঘির চারপাশে পাকা রাস্তা, উত্তর পার্শ্বে পার্কের মত কিছু ফাঁকা জায়গা, তারপর এসডিও অফিস ও এসডিও সাহেবের বাসা। পশ্চিম দিকে অফিসার্স ক্লাব। দক্ষিণ দিকে জনসাধারণের বাড়ি ঘর। বেলা ডোবার সময় বাসা থেকে দীঘীরপাড় দিয়ে হাটা কি যে মজার ছিল ! এখনো মোটামুটি সেই অবস্থায় আছে, তবে অনেক বাড়িঘর উঠে কিছুটা ঘিঞ্জি হয়েছে।
একদিন আমার চেম্বারে বসে আছি। এমন সময় একজন পিয়ন এসে বলল আপনাকে এসডিও সাহেব সালাম দিয়েছে। আমি যথারীতি অলাইকুম আসসালাম দিয়ে বসে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে আবার এসে বলল আপনাকে সালাম দিয়েছে আমি আরেকটু জোরে অলাইকুম আসসালাম বললাম। গতবারের ছালাম শুনতে পাইনি ভেবে। এরপর একজন স্টাফ এসে বললেন আপনাকে কতবার এসডিও সাহেব ডাকলেন কিন্তু একবারও গেলেন না। আমি বললাম কই আমাকে তো ডাকেনি, সালাম দিয়েছে। আমাকে বলল সালাম মানেইতো ডাকা। তখন প্রশাসনের micro culture সম্পর্কে ধারণা হলো। কিছুটা হতাশ হলেও সতর্কতা হলাম।
এসডিও সাহেব আমাদের সাথে অত্যন্ত ভাল ব্যবহার করতেন। শেখানোর চেষ্টা করতেন। সব জেলা ও মহকুমায় এই রকম পরিবেশ ছিল না। বন্ধুদের কাছে শুনেছি যারা ফরিদপুর posting পেয়েছেন জেলা প্রশাসন থেকে তাদের কোনো খোঁজ খবর রাখা হতো না। আমি ভাগ্যবান ইতিবাচক পরিবেশ পেয়েছি।। বাদবাকী জীবন চেষ্টা করেছি অন্যের সাথে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করা। এসডিও ভাবি বাসায় খাবার দাওয়াত দিতেন। সুযোগ সৃষ্টি হলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাকতেন। আমাদেরকে যাত্রা দেখতে নিয়ে গেছে। একত্রে সিনেমা দেখেছি।
এসডিও অফিসের স্পিড বোট ছিল। সেকালে শীতের সময় আড়িয়ালখাঁ নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়তো। মাদারীপুরে ইলিশের আড়ত ছিল। শীতকালে আড়িয়ালখাঁ’র মাঝ বরাবর বাঁশ আর জাল দিয়ে বাঁধ দেয়া হতো। এই বাঁধে ইলিশ মাছ আটকে যেত। আমরা স্পিড বোটে গিয়ে জ্যান্ত ইলিশ তুলতাম। আজকের দিনে আর তা ভাবা যায় না। নদী ভরাট হয়ে গেছে। ইলিশ আর এই নদীতে আসে না। সবাই বলে ইলিশ তোলার সাথে সাথে মরে যায়। আমার অভিজ্ঞতা ভিন্ন। তোলার পর স্পিড বোর্ড এর ভিতরে অনেকক্ষণ ছটফট করতে দেখেছি।
যাহোক মোহাম্মদ আলী পাশা সাথে বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। একসাথে চলাফেরা করতাম। ইতোমধ্যে ডিগ্রি পরীক্ষা এল। আমরা দুজনেই খুব কড়া ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। আগেই বলেছি আমি ছোটখাটো। আমাকে অনেকে প্রথম দর্শনে ম্যাজিস্ট্রেট মনে করতো না। একদিন যথারীতি দু’জনে ডিগ্রিপরীক্ষার হলে ডিউটি করতে গেছি। মোহাম্মদ আলী এক ছেলের নকল ধরেছে। সাথে সাথে ছেলেটি অজ্ঞান হয়ে গেলো। দাঁতে দাঁত এটে গেল। মোহাম্মাদ আলী ছিলেন বাঁহাতি। মুখে বাঁ হাত ঢুকিয়ে মুখ খোলার চেষ্টা করলেন। বিদ্যুৎ গতিতে খবরটি ছড়িয়ে পড়ল। সবাই প্রতিবাদ করলেন, ডিগ্রি ছাত্রের মুখের ভেতর বা হাত দেয়া হয়েছে। আমরা অনভিজ্ঞ এটা এক মহা মুস্কিল। সাথে সাথে এসডিও সাহেবকে জানানো হলো। যাহোক এবেলা কোনরকমে রক্ষা হল। মোহাম্মদ আলী পাশা ভাই কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। বিয়ে করেছিলেন, ভাবি প্রাথমিক বিদ্যালয় এর প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। তার পৈতৃক বাড়ি হাতিরপুলে। তবে পরবর্তীকালে আজিমপুরের চায়না বিল্ডিংএ সস্ত্রীক বসবাস করতেন। তার সাথে ও এখন আর যোগাযোগ নেই।
আমি অনেক unimpressive হলে কি হবে, আমার পিওন আবুল কালাম আজাদ খুব smart. একটা বা দুটো শাদা শার্ট সাদা প্যান্ট থাকলে কি হবে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ইস্ত্রি করা ফিটফাট। একবার একটা তদন্ত দেয়া হল। আড়িয়াল খাঁ নদীর ওপারে, বিখ্যাত সিয়ার্স টাওয়ার, hancock সেন্টারের স্থপতি এবং এফ আর খানের বাড়ির কাছে। গাড়ি ঘোড়ার চলে না হাঁটতে হাঁটতে গেলাম। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা এসে গেল। আবুল কালাম আজাদ কে দেখা মাত্রই তাকে সাদরে বসাতে দেয়ার চেষ্টা করল, সে তো বসতে চায় না। পরে সে বুঝিয়ে দিল আসল লোকটা আমি। পরিমিত কথা বলত। তাকে কখন্ও উল্টোপাল্টা কাজ করতে দেখিনি। ক’ বছর হলো সে মারা গেছে। তাকে আমি এখনো স্মরণ করি। তা’র ছেলেরা আমার সাথে যোগাযোগ করত। এখন সে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। এখান থেকে শিখেছি মানুষকে যদি সুযোগ দেওয়া যায় তবে সে অনেক বড় হতে পারে। সুযোগের অভাবে কেউ ম্যাজিস্ট্রেট, কেউ পিয়ন। তাই বাদ বাকী জীবন চেষ্টা করেছি মানুষের জন্য সুযোগ সৃষ্টির। কখনো বলিনি কে মেধাবী, কে মেধাবী না। মেধার কোন অভাব নেই। অভাব সুযোগের। আমি সবাইকে বলার চেষ্টা করেছি। মেধা নেই বলে কাউকে ছোট করবেন না। যাহোক আগেই বলেছি সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় বসে সবাই কে শুনে তদন্ত শেষ করে ফেললাম। কিন্তু কিভাবে ফিরে যাব? সিদ্ধান্ত নিলাম থেকে যাব? আরো অনেকের কথা বলায় সময় বাড়লো। কথা বলতে বলতে গোলমাল বাধিয়ে দিল। এখান থেকে শিখলাম কারো বাড়িতে অফিসারদের থাকা উচিত নয়। আর কখনোই থাকিনি। পরবর্তী দিনগুলোতে অন্যের কাছে শুনে জেনেছি কত বিপদজ্জনক।
এরপর নৌকায় করে কালকিনি থানার শশিকর স্কুলে গিয়েছি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সহপাঠী দীপক আর অরবিন্দ এই শশিকরের মানুষ। একই স্কুলের ছাত্র। দীপক অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে অবসরে গেছে। অরবিন্দ বলতো সে কখনো দেশ ছেড়ে যাবে না।। সবার আগে সে দেশ ছেড়ে ভারতে গেছে, আর কখনো দেখা হয়নি। শুনেছি state bank of india তে অফিসার। অরবিন্দের সাথে আমরা একত্রে বিকালে পড়াশোনা করতাম। খুবই মেধাবী straight forward। এরপর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন বিরোধী দলের নেত্রী ছিলেন তখন তার পিএস হিসাবে কাজ করার সময় আবুল হোসেনের সাথে পরিচয় হয়। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর শেখ হাসিনার চিকিৎসার সফরসঙ্গী হিসেবে সিঙ্গাপুরে প্রায় মাসখানেক একত্রে থাকার সুযোগ হয়েছে। আরো পরবর্তীতে একত্রে চীন যাওয়ার সুযোগ হয়েছে ২০০১ সালের কথা। স্বল্প সময়ের জন্য আইসিটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আবুল হোসেন সাহেবকে পেয়েছি। আইসিটি মন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন। যে যাই বলুক আমি তাকে ভালো ব্যবহারের মানুষ হিসেবে পেয়েছি। শশিকর যাওয়ার পথে খালের স্বচ্ছ পানিতে মাছের চলাচল স্পষ্ট দেখা যেত। কাজলি মাছ আর পাবদা মাছ ঝাকে ঝাকে দেখেছি। এখন সরাসরি পাকা রাস্তা হয়েছে। খাল আছে তবে খাল দিয়ে কেউ চলাচল করে না। খালের পানি আগের মতো আর কতটা স্বচ্ছ নেই। মাঝে মাঝে বিলের পচা পানি আসে। যাহোক দুপুরের খাবারে প্লেট জোড়া মস্ত বড় একটা সরপুটি খেয়েছি। এত বড় সরপুঁটি জীবনে আর কখনো খাইনি। সেই স্বাদ এখনও জিভে জড়িয়ে আছে।
ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারক হিসেবে কাজ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার জন্য কোর্টে মামলা করার শুরু করেছি। চাকরি স্থায়ীকরণ, দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, তারপর প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার জন্য রেকর্ড করা দরকার। সেজন্য কোর্টে বসা দরকার। তাই প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটে কাশেম সাহেবের সাথে কোর্টে বসতাম, তার কাছে তালিম নিতাম।
এডভোকেটদের সাথে সদ্ভাব ছিল। আওয়ামী লীগের দুই টার্মের নৌমন্ত্রী শাহজাহান খানের বাবা advocates ছিলেন। তার খুব প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। তার বাসায় একদিন এসডিও অফিসের সকল অফিসারদের দাওয়াত দিলে। অন্যান্য খাবারের সাথে দাওয়াতে পাঙ্গাশ মাছ দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। আমার পাতে পাঙ্গাস মাছের পেটি পড়ল। আমি যশোরের মানুষ যশোরে পাঙ্গাশ মাছ পাওয়া যেত না। আজকাল যে চাষের পাঙ্গাশ যশোরেও পাওয়া যায় তা থেকে নদীর পাঙ্গাশ ভিন্ন জাতের। বড় মাছের পেটের সম্পূর্ণটাই চর্বি খেতে খুবই মজা। এখন আমরা জানি চর্বির নিজের কোন স্বাদ না থাকলেও স্বাদ বাড়ায়, খাবার রুচি বাড়ায়। শিবালয় উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার হওয়ার পর কিছুদিন যমুনা নদীর পাঙ্গাসের সেই স্বাদ পেয়েছি। এখন আর সেই স্বাদ পাইনা, তাই পাঙ্গাস খাই না। বয়সের জন্য test but নষ্ট হয়েছে অথবা সঠিক খাবার না পাওয়ার জন্য পাঙ্গাশের স্বাদ নষ্ট হয়েছে। আজও আসমত আলী খান সাহেবের কথা মনে পড়ে। কিছুদিন যাবত মনে করতে বাধ্য হয়েছি। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে পাকিস্তান আমলের পুলিশের intelligence branch 1948 থেকে 1970 সাল পর্যন্ত 40 হাজার পৃষ্ঠার গোপনীয় প্রতিবেদন দিয়েছে বারবার আসমত আলী খানের নাম এসেছে। বঙ্গবন্ধুর বাবা মাদারীপুরে দেওয়ানী আদালতের সেরেস্তাদার হিসেবে জজ কোর্টে চাকরি করেছেন। বঙ্গবন্ধু মাদারীপুরে লেখাপড়া করেছেন। স্কুল কলেজে ছাত্রলীগের পক্ষে ক্যাম্পেইন করেছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষে আন্দোলন করেছেন। যুক্তফ্রন্টের জন্যও ভোট চেয়েছেন। ভগ্নিপতির বাড়ি বেড়াতে এসেছেন। যদি জেলখানাকে বাদ দেই তবে বলা যায় বঙ্গবন্ধুর সেকেন্ড হোম মাদারীপুর।
তখনকার দিনে সকল অফিসারদের মধ্য সদ্ভাব ছিল। কোন ভেদাভেদ ছিল না।
আমরা সদ্য বিবাহিত, জেলা পরিষদের ডাক বাংলো থাকতাম। ১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসের ১৬ তারিখে আমার স্ত্রী আসলেন। এক রুমে দুজন থাকতাম। আমরা দুই টাকার লাফানো চিংড়ি কিনতাম। ৩ টাকায় ১ কেজি দুধ পেতাম। গরুর মাংসের কেজি ১৮ টাকা জেলা পরিষদের বাবুর্চি কুদ্দুস সাহেব আমাদের রান্না করে দিতেন। তার রান্নার স্বাদ আজও ভুলতে পারিনা। সাব-ডিভিশনাল ফুড কন্ট্রোলার হুদা ভাবি রান্না করে খাবার পাঠাতেন। ধানমন্ডি লেক দিয়ে হেঁটে 32 নাম্বারের যাওয়ার সময় হুদা ভাইয়ের সাথে এখনো দেখা হয়।
সোনিয়া নামের ভাবির একটা ছোট বোন ছিল। আমি কাজে ব্যস্ত থাকলে, সোনিয়া আমার স্ত্রীকে সংগ দিতেন।
জেলা পরিষদের ডাক বাংলো দক্ষিণ দিকে ধান ক্ষেতের মধ্যে একটা টিবি হাসপাতাল ছিল। ওই হাসপাতালের ডাক্তার বড়ুয়ার সাথে আমাদের সদ্ভাব ছিল। তারা আমাদের চেয়ে বয়সে বড় তাই স্নেহ করতেন। তখন আমরা একেবারেই junior officer সদ্য বিয়ে করেছি, রান্নাবাড়া চালচুলো ঠিক ছিল না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা সবার বাড়ি বাড়ি বাড়ি খেয়ে বেড়াতাম। আন্তরিকতা এবং সহৃদয়তার কোন অভাব ছিল না। ডাক্তার বড়ুয়ার promotion নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। তারপর দেখা হয়েছিল, এরপর আর দেখা নেই। বেঁচে আছেন না মারা গেছেন তাও জানি না। তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। ভাল ডাক্তার ছিলেন।
মাদারীপুরের আর একজন ছিলেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুল হালিম। তিনি অত্যন্ত চৌকস অফিসার ছিলেন। হালিম ভাবি আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তাদের বাসাতেই বহুদিন খেয়েছি। হালিম সাহেবের সাথে বহুদিন যাবত যোগাযোগ ছিল। সাম্প্রতিক যোগাযোগ নেই। তার কাছেও প্রশাসনের অনেক বিষয় শিখছি। সরাসরি প্রশাসনিক কর্মকর্তা না হলেও বহু প্রশাসনিক কর্মকর্তার সাথে বহু বছর কাজ করেছেন। অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, আমাদের সাথে সবই শেয়ার করতেন, আমি অন্তত বলবো অনেক কিছু শিখেছি তার কাছে। মহাকুমা update হয়ে জেলা হয়ে গেল। কনক কান্তি বড়ুয়া চলে গেলেন। আসলো জেলা প্রশাসক আব্দুর রশিদ। আমি তারা স্টাফ অফিসার হিসেবে কাজ করেছি। তিনি একটা পিছে আর একটা সিগারেট ধরাতেন। দুপুর রাত পর্যন্ত তাস খেলতেন। তার কোন ছুটির দিন ছিল না। তাস তাস খেলার শেষ না হওয়া পর্যন্ত হালিমভাইসহ আমরা বসে থাকতাম। তবে এটা বলা বেশি যৌক্তিক হবে যে, বসে থাকতে বাধ্য হতাম। ভাবীরা ডিসি সাহেবের উপরে স্বভাবতই ক্ষিপ্ত ছিল। আমার বাসার অবস্থা একই। একদিন শুক্রবার আমার স্ত্রী আমার সকল কাপড়-চোপড় নিয়ে বালতিতে ভিজিয়ে দিলেন। আমার যাওয়া বন্ধ করার জন্য। তখনকার দিনে তার বেশি কাপড় ছিল না। তাই অগত্যা সে দিন আর যেতে পারলাম না। সেই রশিদ সাহেব আর নেই। কিভাবে হয়, তারও হাতে খড়ি হল।
সংসারে আমাদের কোন আসবাবপত্র ছিল না। বলতে পারেন ব্রিফকেস সংসার।
মাদারীপুর থাকা কালীন খালি একটা লঞ্চ দুর্ঘটনা হল। ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী সুরতহাল করার দায়িত্ব আমার ওপর পড়ল। পুলিশ অফিসার সহ আমি মর্গে হাজির হয়ে কাজ শুরু করলাম। একটা 20-22 বছরের গাট্টা গোট্টা লাশের বুকে ছুরি একটা টান দিল। 25 থেকে হলুদ চর্বি অনেকটা ফুটে বেরিয়ে পড়ালো। মানুষের চর্বি এই প্রথম দেখলাম। এক মুহূর্তও তার জীবনতো জীবনের কথা ভাবলাম। মাথা ঘুরে চোখে অন্ধকার দেখলাম। কোনোমতে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলাম। কাজ হলো না মনে হলো মাথার ভিতরটা কে চেপে ধরেছে। ভাবছিলাম ওরা যদি বুঝতে পারে তবে ম্যাজিস্ট্রেট সম্পর্কে কি ভাববে। চোখ বন্ধ করে কাউকে বুঝতে না দিয়ে বসে থাকলাম। আস্তে আস্তে সবকিছু ঠিক হয়ে আসলো। আমি সুরতহাল করে ফেরত আসলাম। এরপর চেক কত কষ্টের ঘটনা দেখেছি কিন্তু মন টলেনি। গা-সওয়া বলে কথা আছে। পরিবেশ বিজ্ঞানে পড়েছি acclimatization. আমারও তাই হয়েছে। তখন শিবালয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার উঠলে ব্রিজের উপর একটা সড়ক দুর্ঘটনা হল। একটা বাস 54 জন যাত্রী নিয়ে ব্রিজের উপর থেকে নদীর ভিতর পড়ল। আমার অফিস থেকে বেশি দূরে না। আমি নিজে এসে সবাইকে নিয়ে অনেক যাত্রী এবং উদ্ধার করলাম। চিকিৎসক ও মানুষ মারা গিয়েছিল। মারা যাওয়ার আগে এদের অনেক কে এম এ অবস্থায় পেয়েছে। বেশিরভাগের শরীর দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। রক্তের ধারা কাটা ভাঙ্গা। হাসপাতালে একটা বড় অ্যাম্বুলেন্স, 54 জন মানুষকে কিভাবে পাঠাবো। সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্তঃজেলা বাস থামিয়ে দিলাম। সবাইকে এ দু’চারজন করে আহত মানুষকে নিতে বললাম। কেউ নিতে রাজি না। বললাম আপনারা তো কলাবাগান যাবেন যাওয়ার পথে সরোয়ারদি হাসপাতালের এদেরকে আহতদের নামিয়ে দেবে না। কেউ রাজি না জোর করে গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে গেল। কঠোর হলাম রাস্তায় কাঠ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে গাড়ি থামালাম। প্রতিটা গাড়িতে পাঠিয়ে বললাম না পাঠানো হয় হাসপাতালে নামানো হয় তবে রাস্তায় চলেন দেখব। সবাই ঠিক মত কাজ কাজ করেছে। যথারীতি হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে। বাংলায় কথা ছে সোজা আঙুলে ঘি উঠে না। কি ঝামেলা নিতে চায়। মামলা হলে সাক্ষী দিতে যেতে হতে পারে। পুলিশি ঝামেলা।কিন্তু একথাও আছে “মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি পেতে পারে না”। এখন আর আহত, নিহত, কিংবা দুঃখীদের নিয়ে কাজ করতে করতে আর মাথা ঘোরায় না, কষ্ট হয়, ঘুমোবার আগে, ঘুম থেকে উঠে চিন্তা আবার ভুলে যাই কাজে যাই।
মাদারীপুর আমাকে বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। তখন উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর অভাব। সব থানাগুলোকে উপজেলা করা হয়েছে। সব উপজেলায় উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোট করা হয়েছে। নয় মাসের মাথায় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট করা হলো। মাদারীপুরে posting হওয়ার পর সবাই বলেছিল অপরাধ প্রবণতা খুবই বেশি। ডাকাতদের দেশ। একথা সত্যি যে প্রচুর ফৌজদারি মামলা হত। এরমধ্যে ডাকাতি মামলায় ছিল। এখনো ঢাকার অনেক অপরাধের সাথে মাদারীপুরের চর অঞ্চলের মানুষ জড়িত। মানুষ যখন বিত্তহীন হয়, আয়ের কোনো পথ থাকে না। এমন সময় অসৎ সঙ্গ পায়। তবে সে অপরাধের পথে চলা শুরু করতে পারে।
এই মাদারীপুরে এফ আর খানের মতো মানুষ জন্মেছেন। আমরা কোনো তদবির করিনি বা তদ্বিরকারক ছিল না তাই মাদারীপুর গেছি। তবে মাদারীপুর কে আজও ভুলতে পারেনি। কয়েকবার চুপি চুপি দেখে এসেছি।হয়তো কখনো ভুলতে পারবও না।